’৭১ এর ১৬ আগস্ট: মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দিন
১১ আগস্ট বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরাটাকায় দু’টি জাহাজ দখল করার মধ্য দিয়ে কাদেরীয়া বাহিনীর যোদ্ধারা এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে। এ কারণে পাকিস্তানী সমরবিশারদরা যে কোন মূল্যে কাদের সিদ্দিকীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁর উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেন। কাদেরীয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে হানাদাররা প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে দুই বিগ্রেড সৈন্য নিয়ে পাহাড় এলাকায় ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। ততদিনে কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর বাহিনীর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ তাঁকে বঙ্গবীর, বাঘা সিদ্দিকী, টাইগার সিদ্দিকী ইত্যাদি নামে ডাকা শুরু করেছে। অন্যদিকে তাঁকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পাকিস্তান সরকার।
১৬ আগস্ট ধলাপাড়া আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ঘাটাইল থেকে বংশাই নদীর পাড়ে আসে দখলদার বাহিনী । ধলাপাড়ায় তখন দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। বিচক্ষণ সেনানায়ক টাইগার সিদ্দিকী বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে ঐ দিনই বংশাই নদী পার হওয়া সম্ভব নয়। আবার উন্মুক্ত নদীর তীরে তারা রাত কাটাতেও পারবে না, ফলে মূল ঘাঁটিতে তাদের ফিরতেই হবে। আর সেই সুযোগে ঘরমুখো নিশ্চিন্ত শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের শিক্ষা দিয়ে কিছু অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়া সম্ভব হবে। তিনি মোক্ষম সময়ের আপেক্ষায় হানাদারদের ফিরে যাওয়ার পথের ধারে মাকড়াই এলাকায় ওঁৎ পেতে রইলেন।
সত্যি সত্যি বংশাই নদী পার হতে ব্যর্থ হয়ে দুপুরের দিকে হানাদাররা সেদিনের মতো ফিরে চলেছে। এল.এম.জি হাতে বাঘা সিদ্দিকী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শত্রুদের দিকে। তাঁর ডানে-বামে সহযোদ্ধারা প্রহর গুণছে নির্দেশের অপেক্ষায়। নিশ্চিন্ত মনে যখন হানাদাররা ফিরছে তখন অকষ্মাৎ গর্জে উঠলো বঙ্গবীরের এল.এম.জি। সাথে সাথে মৃত্যুবাণ ছোড়া শুরু করলেন সহযোদ্ধারাও। খোলা মাঠে অকষ্মাৎ আক্রান্ত হয়ে হতচকিত হয়ে পড়ে হানাদার খান সেনারা। ধমনীতে টগবগে রক্ত নেচে ওঠে কাদের সিদ্দিকীর। একটির পর একটি এল.এম.জির চেইন শেষ হয়ে যেতে থাকে। শত্রুনিধনে বিরামহীন গুলিবর্ষণ করছেন তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। হঠাৎ এল.এম.জির চেইন আটকে গেল। এমন সময় ঘটে গেল আরেক বিপত্তি। শত্রুপক্ষের গুলির আঘাতে এল.এম.জি.র ফোর সাইট নব ভেঙ্গে হাতের তালু ভেদ করে গুলিটি বিদ্ধ হলো তাঁর হাঁটুর উপরে। কাদের সিদ্দিকী আহত হলেন, শাহাদাত বরণ করলেন তাঁর সহযোদ্ধা হাতেম। অল্প কয়েক মিনিটের যুদ্ধে ত্রিশ জন হানাদার হতাহত হলো। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই হেঁটে মাকড়াই থেকে মাইল খানেক দক্ষিণে সরে গেলেন তিনি। হাত-পা থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। হাঁটুর উপরের ক্ষতস্থান ধুয়ে দেখতে পেলেন গুলিটি ভিতরে রয়ে গেছে। ক্ষতস্থানের দু’পাশে বারবার চাপ দেওয়ার ফলে বুলেটটি বেড়িয়ে আসলো। হাত-পায়ের ক্ষত নিয়েই প্রায় দু’ মাইল হেঁটে এক সহযোদ্ধার বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেই বাড়িতে একটি টেবিলের উপর শুয়ে পড়তেই তিনি জ্ঞান হারালেন।
যে সময়ে পাহাড় এলাকায় শত্রুর চাপ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, সেই গুরুত্ব¡পূর্ণ সময়ে কাদের সিদ্দিকীর আহত হওয়াটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে নিঃসন্দেহে চরম বিপর্যয়ের। কাদের সিদ্দিকী বুঝতে পারলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁর পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। চিকিৎসার জন্যে নিরাপদ পরিবেশ আবশ্যিক হয়ে পড়লো। জীবন সংকটাপন্ন হলেও তিনি ঠা-া মাথায় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন সাময়িকভাবে যুদ্ধের গতি কমিয়ে ফেলার, সে অনুযায়ী বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে আশা-ভরসা ও অনুপ্রেরণার জ্বলন্ত প্রতীক। তাদের সকল কর্মে ও চিন্তায় তিনিই আদর্শ। তাই তাঁর গুরুতর আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারে। এ কারণে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে এই প্রথম ভারতের পথে পা বাড়ালেন তিনি। কঠোর গোপনীয়তা সত্ত্বেও পাকিস্তানী বাহিনী কাদের সিদ্দিকীর মৃত্যুর বানোয়াট কাহিনী প্রচার করলো। আবার প্রচার করলো তাঁর ডান হাত হারানোর খবর। হানাদার বাহিনী এবং দালালদের মধ্যে এ নিয়ে ম-া-মিঠাই খাওয়ার ধুম পড়ে গেল। চিকিৎসাশেষে বঙ্গবীর আবার ফিরে আসলেন তাঁর সহযোদ্ধাদের মাঝে। তারপরের ইতিহাস আমাদের সবারই কম-বেশি জানা।
কাদেরীয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম গুরুতর আহত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাকড়াই যুদ্ধ এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মাকড়াই যুদ্ধে সত্যিই যদি কাদের সিদ্দিকী শহীদ হতেন তাহলে কী হতো? হয়তো তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হতো! কিন্তু ১১ ডিসেম্বর কি টাঙ্গাইল জেলা হানাদারমুক্ত হতো? ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হতো কি বাংলাদেশ? কেননা কাদের সিদ্দিকী যে সুনিপুণ রণকৌশলে টাঙ্গাইলকে হানাদারমুক্ত করার মাধ্যমে ঢাকার উপকণ্ঠে ভারতীয় ছত্রীসেনাকে নিরাপদে বাংলার মাটিতে নামার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নিজের বাহিনী নিয়ে তাদের সাথে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন, তা এত সহজে সম্ভব হতো না। সেই বিচারে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন কোনভাবেই সম্ভব ছিলো না।
’৭১ এ মাকড়াই ছিলো শাল-গজারী পরিবেষ্টিত এক দুর্গম এলাকা। যদিও বর্তমানে ভালুকার ভরাডোবা থেকে সাগরদীঘি হয়ে ঘাটাইল পর্যন্ত পাকারাস্তা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাথে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ককে সংযুক্ত করেছে। সেই সুবাদে মাকড়াই গ্রামের উপর দিয়েও চলে গেছে সেই পাকা রাস্তা। অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমে বলীয়ান কাদের সিদ্দিকী সেদিনকার দুর্গম মাকাড়াইতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেও বিগত ৪৩ বছরে কোন সরকারই শহীদ হাতেমের আত্মোৎসর্গ ও বাঘা সিদ্দিকীর পবিত্র রক্ত ঝরার এই স্থানকে সংরক্ষণ করার বা কোন স্মৃতি স্মারক নির্মাণ করার ন্যুনতম উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। কাদেরীয়া বাহিনীর উদ্যোগে শুধুমাত্র জায়গাটুকু চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। প্রতি বছরের মতোই এবারও টাঙ্গাইল জেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের উদ্যোগে মাকড়াইয়ের সেই স্মৃতি বিজড়িত স্থানে দিনব্যাপী কোরানখানি, আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
ক্ষমতাবানদের নিপীড়নের ভয়ে সত্য বলার লোকের যখন বড়ই অভাব, তখনও বাংলার এই অকুতোভয় বীর সেনানী কারও রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে, যা তিনি জানেন ও বিশ্বাস করেন সে কথা বলে চলেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। আর এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও এখন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সিপাহসালার সেজেছেন তাদের মনগড়া বিকৃত তথ্য সম্বলিত ইতিহাস শুনতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের এ জীবন্ত কিংবদন্তিকে। মুক্তিযুদ্ধের ‘সোল এজেন্ট’ ও তাদের দোসরদের পক্ষ থেকে ‘রাজাকার’, ‘নব্য রাজাকার’ এমনকি ‘যুদ্ধাপরাধীর’ অপবাদ দেয়া হয়েছে তাঁকে। সরকারি দলের রাজাকারদেরও বিচার চাওয়ায় তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে আদালতের কাঠগড়ায়, তাঁর নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।
পাকিস্তানী হানাদারদের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়াতে যিনি কুণ্ঠিত হননি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সবাই যখন শেয়ালের গর্তে লুকিয়েছিল হাজারও বৈরীতার মধ্যেও প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন যিনি, কোন ধরনের ভেংচি দিয়ে তাঁকে সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পথ থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। যে স্বপ্ন নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছিলেন বঙ্গবীর, সেই কাঙ্খিত বাংলাদেশ তিনি যেন দেখে যেতে পারেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আহত হওয়ার এই ‘মাকড়াই দিবসে’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এটাই প্রার্থনা।
No comments