TjT

করনা প্রতিরোধে হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন। অপরিষ্কার হাত দিয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ্ করা থেকে বিরত থাকুন। অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতের তালুতে নিয়ে ( 20 সেকেন্ড ) ভাল করে পরিষ্কার করুন। ব্যবহৃত টিস্যু ঢাকনা যুক্ত ডাস্টবিনে ফেলুন। পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির সাথে হাত মেলানো বা আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকুন। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।

সিন্দুক (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ


মিসির আলির ঘর অন্ধকার। তিনি অন্ধকার ঘরে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। চেয়ারে পা তুলে বসে থাকার বিষয়টা আমার অনুমান। অন্ধকারের কারণে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে পা তুলে জবুথবু ভঙ্গিতে বসে থাকা তাঁর অভ্যাস।


 



আমি বললাম, ঘরে মোমবাতি নাই?


 


মিসির আলি বললেন, টেবিলে মোমবাতি বসানো আছে। এতক্ষণ জ্বলছিল। আপনি ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে বাতাসে নিভে গেছে।


 


 


আমি বললাম, মোমবাতি জ্বালাব? নাকি অন্ধকারে বসে থাকবেন?


 


মিসির আলি বললেন, থাকি কিছুক্ষণ অন্ধকারে। আঁধারের রূপ দেখি।


 


বিশেষ কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলেন?


 


 


মিসির আলি বললেন, আপনার কি ধারণা সারাক্ষণ আমি কিছু-না-কিছু নিয়ে চিন্তা করি? চিন্তার দোকান খুলে বসেছি? পকেটে দিয়াশলাই থাকলে মোমবাতি জ্বালান। একা একা অন্ধকারে বসে থাকা যায়। দুজন অন্ধকারে থাকা যায় না।


 


কেন?


 


দুজন হলেই মুখ দেখতে ইচ্ছা করে।


 


আমি মোম জ্বালালাম। আমার অনুমান ঠিক হয় নি। মিসির আলি পা নামিয়ে বসে আছেন। তাঁকে সুখী সুখী লাগছে। বিয়েবাড়ির খাবার খাওয়ার পর পান মুখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালে চেহারায় যে সুখী সুখী ভাব আসে সেরকম।


 


 


মিসির আলি বললেন, বিশেষ কোনো কাজে এসেছেন নাকি গল্পগুজব?


 


গল্পগুজব।


 


মিসির আলি বললেন, আপনি কি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন? আমরা সব সময় বলি গল্পগুজব। শুধু গল্প বলি না। তার অর্থ হচ্ছে আমাদের গল্পে গুজব একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আমাদের গল্পের একটা অংশ থাকবে গুজব। ইংরেজিতে কিন্তু কেউ বলে না। Story Rumour, কারণ Rumour ওদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।


 


আমি বললাম, আপনি গল্পই বলুন। গুজব বাদ থাক।


 


কী গল্প শুনবেন?


 


 


যা বলবেন তাই শুনব। আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনি। শৈশব-কথা। আপনার বাবা কি আপনার মতো ছিলেন?


 


আমার মতো মানে?


 


জটিল চিন্তা করা টাইপ মানুষ।


 


আমার বাবা নিতান্তই আলাভোলা ধরনের মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রিয় শব্দ হল আশ্চৰ্য। কোনো কারণ ছাড়াই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা ছিল। উদাহরণ দেব?


 


দিন।


 


 


একবার একটা প্রজাপতি দেখে কী আশ্চর্য! কী আশ্চৰ্য বলে তার পেছন পেছন জুটলেন। তিনি শুধু যে একা ছুটলেন তা না, আমাকেও ছুটতে বাধ্য করলেন। প্রজাপতির একটা ডানা ছিঁড়ে গিয়েছিল। বেচারা একটা ডানায় ভর করে উড়ছিল।


 


আমি বললাম, আশ্চৰ্য হবার মতোই তো ঘটনা।


 


মিসির আলি বললেন, তা বলতে পারেন। তবে দিনের পর দিন এই ঘটনার পেছনে সময় নষ্ট করা কি ঠিক? তাঁর প্রধান কাজ তখন হয়ে দাঁড়াল প্রজাপতি ধরে ধরে একটা ডানা ছিঁড়ে দেখা সে এক ডানায় উড়তে পারে কি না। শুধু প্রজাপতি না, তিনি ফড়িং ধরেও ডানা ছিঁড়ে দেখতেন উড়তে পারে কি না। বাবার এই কাজগুলো আমার একেবারেই পছন্দ হত না। কৌতূহল মেটানোর জন্য তুচ্ছ পতঙ্গকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না।


 


আপনার বাবার পেশা কী ছিল?


 


উনি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। উলা পাস শিক্ষক। যদিও আমাকে তিনি মাদ্রাসায় পড়তে দেন নি। তিনি লম্বা জুব্বা পরতেন। জুঘার রঙ সবুজ, কারণ নবীজি সবুজ রঙের জুম্বা পরতেন। বাবার ঝোঁক ছিল সত্য কথা বলার দিকে। তাঁর একটাই উপদেশ ছিল, সত্যি বলতে হবে। তাঁকে খুব অল্প বয়সে সত্যি বিষয়ে আটকে ফেলেছিলাম। শুনবেন সেই গল্প?


 


বলুন শুনি।


 


আমি তখন ফ্লাস সেভেনে পড়ি। বাবা মাগরেবের নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে আছেন!! এশার নামাজ শেষ করে তিনি উঠবেন। এই আঁর নিয়ম। দুই নামাজের মাঝখানের সময়ে তিনি তসবি টানতেন, তবে সাধারণ কথাবার্তাও বলতেন! সেদিন ইশারায় আমাকে জায়নামাজের এক পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে কিছু দোয়া-দরুদ পড়ে যথারীতি বললেন, বাবা, সত্যি কথা বলতে হবে। সব সময় সত্যি।


 


আমি বললাম, আচ্ছা বাবা মনে কর তুমি একটা নৌকায় বসে আছ, নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা, তখন একটা মেয়ে দৌড়ে এসে তোমার নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে পড়ল। তাকে কিছু দুষ্ট লোক তাড়া করছে। মেয়েটি লুকানোর কিছুক্ষণ পর ডাকাত দল এসে পড়ল। তারা তোমাকে বলল, একটা মেয়েকে আমরা খুঁজছি। তাকে কোনো দিকে যেতে দেখেছেন? তার উত্তরে তুমি কি সত্যি কথা বলবে?


 


ধাবা কিছু সময় হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দুষ্ট তর্ক ভালো না বাবা।


 


মোমবাতি আবার বাতাসে নিভে গেছে। মিসির আলি বাতি জ্বালালেন।


 


আমি বললাম, আপনার তর্কবিদ্যার সেটাই কি শুরু?


 


মিসির আলি বললেন, শুরুটা বাবা করে দিয়েছিলেন। তবে তর্কবিদ্যা না। তার ছিল চিন্তাবিদ্যা। চিন্তা বা লজিকনির্ভর অনুমান বিদ্যা।


 


বলুন শুনি।


 


মিসির আলি বললেন, বাবার আমার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। দুবছর বয়সে আমার মা মারা গেছেন। মার স্নেহ পাই নি! এ নিয়ে তাঁর মনে কষ্ট ছিল। তিনি আমাকে আনন্দ দেবার জন্য নানান খেলা খেলতেন। প্রধান খেলা ছিল টিনের কোটায় কিছু মার্বেল ঢুকিয়ে ঝাকানো। ঝাকানোর পরে বলতেন-বাবা, বল মার্বেল কয়টা? বলতে পারলে লজেন্স।


 


আমি যে কোনো একটা সংখ্যা বলতাম। কৌটা খুলে দেখা যেত সংখ্যা ঠিক হয় নি। বাবা বলতেন, যা মনে আসে তাই হুটু করে বলবা না। চিন্তা করে অনুমানে যাবা। যদি একটা মার্বেল থাকে সেই মার্বেল টিনের গায়ে শব্দ করবে। দুটা মার্বেল থাকলে টিনের গায়ে শব্দ হবে, আবার মার্বেলে মার্কেলে ঠোকাঠুকি হয়ে আরেক ধরনের শব্দ হবে। তিনটা মার্বেল থাকলে তিন রকমের শব্দ। মূল বিষয় হল শব্দ নিয়ে চিন্তা। মানুষ এবং পশুর মধ্যে একটাই প্ৰভেদ। মানুষ চিন্তা করতে পারে, পশু পারে না।


 


আমি বললাম, বাবা পশুও হয়তো চিন্তা করতে পারে। মুখে বলতে পারে না।


 


বাবা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমার কারণে তাকে অনেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়েছে। সেই দীর্ঘনিঃশ্বাসে পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশার চিহ্ন ছিল। বাবার কৃথা বাদ থাকা! আপনি এসেছেন। আমার যে কোনো একটা অমীমাংসিত রহস্যের গল্প শুনতে। তেমন একটা গল্প বলি।


 


আমি বললাম, আপনার বাবার গল্প শুনতে ভালো লাগছে। বাবার গল্পই বলুন। মার্বেলের শব্দ নিয়ে তাঁর খেলাটা তো শুনতে খুবই ভালো লাগল। কোনো বাবা তার সন্তানকে নিয়ে এ ধরনের খেলা খেলেন বলে মনে হয় না।


 


মিসির আলি বললেন, অমীমাংসিত রহস্যটা বাবার সিন্দুক নিয়ে। এই অর্থে এটা হবে বাবারই গল্প। শুরু করি?


 


করুন।


 


বাবার একটা সিন্দুক ছিল। বিশাল সিন্দুক। লোহা কাঠের তৈরি। লোহা কাঠ কী বস্তু আমি জানি না। বাবা বলতেন—লোহা কাঠ হচ্ছে সেই কাঠ যেখানে লোহার পেরেক ঢুকে না। আমার নিজের ধারণা সিন্দুকটা ছিল সিজন করা বাৰ্মা টিকের। সিন্দুকের গায়ে পিতলের লতাপাতার নকশা ছিল। সিন্দুকের চাবি ছিল দুটা। একটা চাবি প্রায় আধাফুট লম্বা। দুটা চাবিই রুপার তৈরি। চাবি দুটা সব সময় বাবার কোমরের ঘুনাসির সঙ্গে বাধা থাকত। গোসলের সময়ও তিনি চাবি খুলতেন না।


 


শৈশবে আমি ভাবতাম সিন্দুকে সোনার থালা-বাসন আছে। কারণ প্রায়ই গল্প শুনতাম নদীতে সোনার থালা-বাসন ভেসে উঠেছে। আর্কিমিডিসের সূত্রে পানিতে সোনার থালা-বাসন ভেসে ওঠার কথা না। তবে শৈশব সব রকম সূত্র থেকে মুক্ত।


 


সিন্দুক প্রসঙ্গে যাই। সিন্দুকের ওপর শীতলপাটি পাতা থাকত। বাবা সেখানে ঘুমাতেন। তিনি কোনো বালিশ ব্যবহার করতেন না। ডান হাতের তালুতে মাথা রেখে ঘুমাতেন। খুব ছেলেবেলায় আমিও বাবার সঙ্গে ঘুমাতাম।


 


একটু বড় হবার পর বিছানায় চলে আসি, কারণ দুজনের চাপাচাপি হত। বাবা রাতে খুব যে ঘুমাতেন তা না। এবাদত-বন্দেগি করেই রাত পার করতেন। রাতে ঘরে সব সময় হারিকেন জ্বলত। বাবা যা পেতেন। এক রাতের কথা বললেই বুঝতে পারবেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙেছে। ঘর অন্ধকার। জানালা দিয়ে সামান্য চাদের আলো আসছে। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। সামান্য কাঁপছেন। আমি বললাম, বাবা কী হয়েছে?


 


বাবা বললেন, সর্বনাশ হয়েছে রে। ব্যাটা। হারিকেন নিভে গেছে। কেরোসিন শেষ, আগে খিয়াল করি নাই।


 


আমি বললাম, মোমবাতি তো আছে।


 


বাবা মনে হল জীবন ফিরে পেলেন। কঁপা গলায় বললেন, মোমবাতি আছে নাকি? কোনখানে?


 


আমি শিকায় ঝুলানো হাঁড়ির ভেতর থেকে বাবাকে মোমবাতি এনে দিলাম। তিনি ক্রমাগত বলতে লাগলেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানি।


 


মোমবাতি জ্বালানো হল। তাকিয়ে দেখি ভয়ে—আতঙ্কে বাবার মুখ পাংশু বর্ণ। কপালে ঘাম। আমি বললাম, তুমি অন্ধকার এত ভয় পাও কেন বাবা?


 


বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আছে ঘটনা আছে। তোকে বলা যাবে না। তুই পুলাপান মানুষ। ভয় পাবি।


 


এই সময় আমাদের ঘরের পেছন দিকে ধুপধাপ শব্দ হতে শুরু করল। আমি বললাম, শব্দ কীসের বাবা?


 


বাবা বললেন, খারাপ জিনিস হাঁটাচলা করতেছে। তিনি ক্ৰমাগত আয়াতুল কুরসি পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিতে লাগলেন।


 


আপনার বয়স তখন কত?


 


ফ্লাস ফাইভে পড়ি। নয়-দশ বৎসর বয়স হবে। ঘটনাটা মন দিয়ে শুনুন। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে স্তয়ে থারথার করে কঁপিছেন। ধূপধাপ শব্দ হচ্ছে। একনাগাড়ে না। মাঝে মাঝে থামছে। আবার শুরু হচ্ছে। আমি বললাম, বাবা কেউ টেকিতে ধান কূটছে। ঢেঁকির শব্দ।


 


বাবা বললেন, গাধার মতো কথা বলবি না। আমার বাড়ির পেছনে কি ঢেঁকি ঘর?


 


আমি বললাম, শব্দ দূরে হচ্ছে। রাতের কারণে শব্দ কাছে মনে হচ্ছে।


 


বাবা বললেন, এত রাতে কে ঢেঁকিতে পাড় দিবে?


 


আমি বললাম, হিন্দু বাড়িতে সকাল হবার আগেই ঢেঁকি শুরু হয়। এখনই সকাল হবে।


 


আমার কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদের আজান শোনা গেল। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, মাশাল্লাহ। মাশাল্লাহ। আল্লাহপাক তোর মাথায় বুদ্ধি দিয়েছেন।


 


মিসির আলি হিসেবে সেটাই কি আপনার প্রথম রহস্যভেদ?


 


তা বলতে পারেন। তবে ঢেঁকির শব্দের রহস্যভেদ ছাড়াও ঐ রাতে আমি প্রথম বুঝতে পারি। আমার বাবা অসুস্থ। কী অসুখ জানি না, তবে তিনি যে খুবই অসুস্থ একজন মানুষ সেটা নিশ্চিতভারে বুঝে ফেলি। এখন আমি বাবার অসুখের নাম জানি, সাইকোলজির ভাষায় এই অসুখের নাম পেরানোয়া! কারণ ছাড়া ভয়ে অস্থির হয়ে যাওয়া। সব সময় ভাবা তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।


 


বাবা মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিলেন, কারণ মাদ্রাসায় যেতে হলে সেনবাড়ির ভিটার ওপর দিয়ে যেতে হয়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা! সেখানে নাকি খারাপ জিনিসরা তাকে ধরার জন্য বসে থাকে। একবার একটায় ধরেও ফেলেছিল। তিনি অনেক কষ্টে ছাড়া পেয়েছেন।


 


বাবার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার একটি গল্প শুনুন। তিনি একবার বাড়িতে মাদ্রাসার এক তালেবল এলেমকে নিয়ে এলেন। আমাকে কানে কানে বললেন, এ কিন্তু মানুষ না, জিন। মানুষের বেশ ধরে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে।


 


আমি বললাম, কীভাবে বুঝলে?


 


বাবা বললেন, সবাই জানে। একবার সে মাদ্রাসার হোষ্টেলে তার ঘরে শুয়ে আছে। তার একটা বই দরকার। বইটা অনেক দূরে টেবিলের উপর। সে বিছানা থেকে না উঠে হাতটা লম্বা করে টেবিল থেকে বই নিল।


 


কে দেখেছে?


 


তার রুমমেট দেখেছে। সে-ই সবাইকে বলেছে।


 


জিনটার নাম কী?


 


কালাম। পড়াশোনায় তুখোড় ছাত্র।


 


জিন কালাম দুপুরে আমাদের সঙ্গে কৈ মাছ খেল। এবং গলায় কৈ মাছের কাটা ফুটিয়ে অস্থির হয়ে পড়ল।


 


আমি বাবাকে বললাম, বাবা সে জিন। তার গলায় কাঁটা ফুটবে কেন?


 


বাবা বললেন, মানুষের বেশ ধরে আছে তো। এই জন্য ফুটেছে।


 


আমি বললাম, এখন কিছুক্ষণের জন্য জিন হয়ে কাঁটা দূর করছে না কেন?


 


বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, সেটাও একটা বিবেচনার কথা।


 


মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে বাবা দিনরাত ঘরেই থাকেন। তাঁর প্রধান কাজ সিন্দুক ঝাড়পোছ করা। তেল ঘষা। আগে মাসে একদিন তিনি বাটিতে রেড়ির তেল নিয়ে বসতেন। সিন্দুকে তেল ঘষতেন। এখন প্রতি সপ্তাহে তেল ঘষেন। তবে সিন্দুকের ডালা কখনো খোলেন না। আমি একদিন বললাম, বাবা, সিন্দুকের ভেতর কী আছে?


 


বাবা বললেন, সিন্দুকে কী আছে তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি এই সিন্দুকের ধারে কাছে আসবা না। নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকবা। ক্লাস ফাইভে বৃত্ত পরীক্ষা আছে। বৃত্ত যেন পাও সেই চেষতা নাও। তোমার নিজের টাকাতে তোমাকে পড়তে হবে। আমি অক্ষম।


 


প্রায়ই দেখতাম বাবা সিন্দুকের গায়ে কান লাগিয়ে লাগিয়ে বসে আছেন। যেন সিন্দুকের ভেতর কিছু হচ্ছে। তিনি তাঁর আওয়াজ পাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমাকে দেখলে তিনি খুব লজ্জা পেতেন।


 


ক্লাস ফাইভে কি আপনি বত্তি পেয়েছিলেন?


 


না। বৃত্তি পরীক্ষাই দেয়া হয় নি। বৃত্তি পরীক্ষার সময় বাবা খুবই অসুস্থ। এখন মারা যান। তখন মারা যান অবস্থা। আমি সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে আছি। বাবার মাথা তখন বেশ এলোমেলো। সিন্দুকের চাবি তার ঘুনসিতে বাধা। তারপরেও দুই হাতে চাবি চেপে ধরে বসে থাকেন। তাঁর একটাই ভয়, খারাপ জিনিসগুলো চাবি চুরি করে নিয়ে সিন্দুক খুলে ফেলবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে।


এক রাতের কথা। বাবার জ্বর খুব বেড়েছে। তিনি সিন্দুকের ওপর ঝিম ধরে বসে আছেন। হঠাৎ আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি তার কাছে গেলাম। বাবা বললেন, সিন্দুকে কান দিয়ে শোন তো দেখি। কিছু কি শোনা যায়?

আমি সিন্দুকে কান রাখলাম।

বাবা বললেন, কিছু শুনতে পাচ্ছিস?


আমি বললাম, হুঁ। 


কী শুনা যায়?


 


বুঝতে পারছি না।


 


বাবা বললেন, সিন্দুকের ভেতর কেউ কি নূপুর পায়ে হাঁটে?


 


আমি বললাম, হুঁ।



বাবা বললেন, ভালোমতো শোন। পরিষ্কার করে ফুল। হুঁ-হাঁ না। আমার সময় শেষ। তোকে সিন্দুকের দায়িত্ব বুঝায়া দেয়ার সময় হয়ে গেছে। দায়িত্ব বুঝায়ে দিতে পারলে আমার মুক্তি। তার আগে মুক্তি নাই। কী শুনা যায়, বল।


 


আমি বললাম, নূপুর পায়ে সিন্দুকের ভেতর কেউ হাঁটছে। থেমে থেমে হাঁটে।



বাবা বললেন, এখন বুঝতে পারছিস কেন সিন্দুকে কান দিয়ে থাকি?



বুঝতে পারছি। সিন্দুক খোলো। দেখি ভেতরে কী।



বাবা রাগী গলায় বললেন, সিন্দুক খোলার নাম মুখেও নিবি না। আমার ব্যাপঞ্জান মৃত্যুর সময় সিন্দুকের দায়িত্ব আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছেন, কখনো যেন সিন্দুক না খুলি। আমি খুলি নাই। তুইও খুলবি না। সিন্দুকের চাবি সারা জীবন সঙ্গে রাখবি।


 


আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বাবা, আমি যখন সিন্দুকে কান চেপে ধরেছিলাম তখন তুমি শরীর দুলাচ্ছিলে। শরীর দুলানোর জন্য সিন্দুকের চাবি ঠুকাঠুকি হয়ে নূপুরের মতো শব্দ হয়েছে।


 


বাবা বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোর বুদ্ধি মাশাল্লাহ খুবই ভালো। আমার মৃত্যুর পর সিন্দুকে কান চেপে ধরবি। যখনই সময় পাবি তখনই ধরবি। নানান ধরনের শব্দ শুনবি। কিশোরী মেয়ে মানুষের গলা, মেয়েমানুষের হাসি। প্রশ্ন করলে মাঝে মাঝে জবাব পাবি। শুধু একটাই কথা, সিন্দুক খুলবি না।


 


এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে বুধবার রাতে বাবা মারা গেলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর মুখে একটাই কথা-সিন্দুকের চাবি। আমার সিন্দুকের চাবি খারাপ জিনিসে নিয়ে গেছে। সর্বনাশ! আমার মহাসর্বনাশ।


 


তাঁর কোমরের ঘুনসিতে চাবি ছিল না। পুরো বাড়ি তনুতন্ন করে খুঁজেও চাবি পাওয়া গেল না।


 


বাবার মৃত্যুর পর আমি অর্থই সমুদ্রে পড়লাম। পড়াশুনা বন্ধ হবার উপক্রম হল। তখন আমাদের স্কুলের অঙ্ক স্যার প্রণব বাবু বললেন, তুই আমার বাড়িতে উঠে আয়। এই বাড়ি তালাবদ্ধ থাকুক।


 


আমি স্যারের বাসায় উঠলাম। স্যারের স্ত্রীর নাম দুৰ্গা। তিনি আমাকে বললেন, তুই আমার ঠাকুরঘরে কখনো ঢুকবি না। পানি বলবি না, বলবি জল। তা হলেই হবে। এখন আয় আমাকে প্ৰণাম কর। পায়ে হাত না দিয়ে প্ৰণাম কর। স্নান করে। এসেছি। ঠাকুরঘরে ঢুকব।


 


প্রথম দিন মহিলার কথায় আহত হয়েছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝলাম। এই পৃথিবীতে পাঁচজন ভালো মানুষের মধ্যে তিনি একজন। তিনি কখনো বলেন নি আমাকে মা ডাক। কিন্তু আমি তাঁকে মা ডাকতাম। তিনি আমাকে ডাকতেন মিছরি। তাঁর মৃত্যুর পর আমি মুখাগ্নি করি। কারণ তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর মুসলমান বন্দপুলাটা যেন আমার মুখাগ্নি করে।


 


তাদের পরিবার কঠিন নিরামিষাশী ছিল। আমাকে নিরামিষ খাবার খেতে হত। আমার আমিষ খাবার অভ্যাস যেন নষ্ট না হয়ে যায় এই জন্য মা আমাকে আলাদা হাঁড়িতে মাঝে মধ্যে ডিম রান্না করে দিতেন। আমার মায়ের গল্প আলাদাভাবে আরেকদিন বলব। আমার unsolved খাতায় উনার ছোট্ট একটা অংশ আছে। উনি প্ৰতি অমাবস্যায় অপদেবতাদের ভোগ দিতেন। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে কলাপাতায় করে গজার মাছ পুড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন, ভোগ দেবার কিছুক্ষণের মধ্যে একজন অপদেবতা ভোগ গ্রহণ করার জন্য আসতেন। সেই অপদেবতার চোখ নেই। তার শরীরে মাংস পুড়ার গন্ধ। একদিন আমি মার সঙ্গে অপদেবতাকে ভোগ দিতে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এই অংশটা বাদ। আজি বরং সিন্দুকের গল্পটা করি।


 


আমি স্কুল ছুটির দিনে নিজের বসতবাড়িতে যেতাম। বাড়ি তালাবদ্ধ থাকত। তালা খুলে ঘর ঝাঁট দিতাম। এবং বেশ কিছু সময় সিন্দুকে কান লাগিয়ে বসে থাকতাম। সিন্দুকের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসত না। আসবে না জানতাম, তারপরেও অভ্যাসবশে কান লাগিয়ে থাকা।


 


একদিনের কথা। সিন্দুকে কান লাগিয়ে বসে আছি। হঠাৎ শুনলাম রিনারিনে মেয়েদের গলায় কেউ একজন বলল, এই এই। আমি আমি আমি। এই এই।


 


আতঙ্কে আমার শরীর প্রায় জমে গেল। আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। মনে হচ্ছে সিন্দূকটা সামান্য নড়ছে। কেউ একজন প্রাণপণ চেষ্টা করছে ভেতর থেকে সিন্দুকের ডালা খুলার। কেউ একজন বন্দি হয়ে আছে। বের হবার চেষ্টা করছে। দৌড়ে প্রণব স্যারের বাড়িতে চলে গেলাম। ঘর তালাবদ্ধ করার কথাও মনে হল না। সেদিন এতই ভয় পেয়েছিলাম যে রাতে জ্বর এসে গিয়েছিল। জুরের ঘোরে কানের কাছে সারাক্ষণ কেউ একজন বলছিল, এই এই এই। আমি আমি আমি। এই এই এই।


 


পরের সপ্তাহ আবার গেলাম। সিন্দুকে কান লাগানো মাত্র শুনলাম—এই এই এই।


 


আমি বললাম, আপনি কে?


 


উত্তরে শুনলাম, আমি আমি আমি।


 


আপনার নাম কী?


 


আমি আমি আমি।


 


সিন্দুকের ভেতর কীভাবে ঢুকলেন? উত্তরে সেই পুরোনো শব্দ-‘আমি আমি আমি।’ তবে শব্দ স্পষ্ট।


 


ইলেকট্রসিটি চলে এসেছে। মিসির আলি ফুঁ দিয়ে বাতি নেভালেন। তাকিয়ে দেখি মিসির আলির কপালে ঘাম। তিনি এখনো গল্পের ভেতরে আছেন। যেন চোখের সামনে সিন্দুক দেখছেন।


 


আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব। ভাই, এটা কি কোনো অডিটরি হেলুসিনেশন হতে পারে?


 


হ্যাঁ, হতে পারে। সিন্দুক নিয়ে আমার কিশোর মনে প্রবল কৌতুহল থেকে ঘোর তৈরি হতে পারে। তবে ঘোর ছিল না।


 


কীভাবে বুঝলেন ঘোর ছিল না?


 


আমি আমার মাকে অর্থাৎ প্রণব স্যারের স্ত্রীকে বাড়িতে এনেছিলাম। তাকে বললাম, সিন্দুকে কান রাখতে। তিনি কিছু শুনেন কি না। তিনি কান রাখলেন এবং অবাক হয়ে বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে বলছে- আমি আমি আমি। ঘটনা কী রে?


 


আমি বললাম, জানি না।


 


মা বললেন, এর চাবি কই? চাবি আন সিন্দুক খুলব।


 


আমি বললাম চাবি নাই। চাবি হারিয়ে গেছে।


 


মা বললেন, আমার ধারণা সিন্দুকে অনেক ধনরত্ন আছে। ধনরত্ন পাহারা দেবার জন্য বাচ্চা কোনো মেয়েকে সিন্দুকের ভেতর ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মেয়েটাকে যাক করা হয়েছে। আগেকার মানুষের বিশ্বাস ছিল যাক ধনরত্ন পাহারা দেয়। মিস্ত্রি দিয়ে সিন্দুক খোলা দরকার কিন্তু সেটা ঠিক হবে না।


 


ঠিক হবে না কেন?


 


চারদিকে জানাজানি হবে। সিন্দুক খুলতে হবে গোপনে।


 


মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন সিন্দুকের চাবির সন্ধান পাই।


 


কীভাবে পান?


 


নিজেই চিন্তা করে বের করি চাবিটা কোথায় থাকতে পারে। চাবি সেখানেই পাওয়া যায়। লজিক্যাল ডিডাকশন কীভাবে করলাম। আপনাকে বলি।


 


চাবি দুটা বাবার কোমরের ঘূনসিতে বাধা থাকত। কাজেই চাবি পড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!


 


বাবার কথামতো খারাপ জিনিস। তাঁর কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নিয়েছে এও হবার কথা না। বাবা নিজেই লুকিয়ে রেখেছেন।


 


তার শরীর তখন খুবই খারাপ ছিল। কাজেই দূরে কোথাও লুকাবেন না। বাড়ির ভেতর বা বাড়ির আশপাশে লুকাবেন।


 


মাটি খুঁড়ে কোথাও লুকাবেন না। মাটি খোড়ার সামৰ্থ্য তাঁর ছিল না। আর খোড়াখুঁড়ি করলেই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।


 


কাজেই তাঁর চাবি লুকানোর একমাত্র জায়গা-ইঁদারা। বাড়ির পেছনেই ইঁদারা। বাবা অবশ্যই ইন্দারার পানিতে চাবি ফেলে দিয়েছেন। আমাদের বাড়ির ইঁদারার চারপাশ বাঁধানো ছিল। অসুস্থ অবস্থায় বাবা ইদারায় হেলান দিয়ে অনেক সময় কাটাতেন।


 


ইঁদারা থেকে চাবি উদ্ধারের কাজ মোটেই জটিল হয় নি। ইদারায় বালতি বা বদন পড়ে গেলে তা তোলার জন্য আঁকশি ছিল। জিনিসটা একগোছা মোটা বড়শির মতো। দড়িতে বেঁধে আঁকশি ফেলে নাড়াচাড়া করলেই হত। ডুবন্ত জিনিস বঁড়শিতে আটকাত।


 


আপনি চাবি পেয়ে গেলেন?


 


হ্যাঁ।


 


সিন্দুক খুললেন?


 


হ্যাঁ।


 


সিন্দুকে কী ছিল?


 


মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, সিন্দুক ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। কিছুই ছিল না।

কিছুই ছিল না? 


এক টুকরা কালো সুতাও ছিল না।



এরপরেও কি আপনি সিন্দুকে কান রেখে কথা শোনার চেষ্টা করেছেন?


করেছি। কিছুই শুনি নি। সিন্দুকের গল্পের এখানেই শেষ। যান, বাসায় চলে যান। অনেক রাত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.

আসুন করনা সম্পর্কে সচেতন হই সুস্থ থাকি ।