রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অল্প বয়সে মারা যাওয়া বাংলাদেশি কবি লেখকদের মাঝে অন্যতম জনপ্রিয় একজন
রুদ্র অল্প বয়সে মারা যাওয়া বাংলাদেশি কবি লেখকদের মাঝে অন্যতম জনপ্রিয় একজন। পুরো নাম তার রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
রুদ্রর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। তার মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে। ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞান শাখায় ১ম বিভাগে রুদ্র এসএসসি পাস করেন। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল, রুদ্র ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র বিজ্ঞানের পথে আর না গিয়ে তার পছন্দের মানবিক শাখায় চলে এলেন।
ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন; সহপাঠী হিসেবে পেলেন কামাল চৌধুরী, আলী রিয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, ইসহাক খানসহ একঝাঁক তরুণ সাহিত্যকর্মীকে। ১৯৭৫ সালে রুদ্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ২য় বিভাগে। দু’বছরে তিনি ক্লাস করেছিলেন মাত্র ১৮টি। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে।
রুদ্র ছিলেন ঢাবির সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। কিন্তু তিনি বেশি থাকতেন ফজলুল হক হলে বন্ধু কামাল চৌধুরীর ৩০৯ নাম্বার কক্ষে অথবা রেজা সেলিমের ১১০ নাম্বার কক্ষে। ১৯৭৯ সালে রুদ্রর অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় বাংলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর আহমদ শরীফ তাকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেননি। পরের বছর, ১৯৮০ সালে তিনি অনার্স পাস করেন। এরপর নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আবারও পিছিয়ে পড়েন রুদ্র। ১৯৮৩ সালে নেন এমএ ডিগ্রি।
ছাত্রজীবনেই রুদ্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, ‘উপদ্রুত উপকূল’ আর ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। প্রথম বইটির প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। দুটি বইয়ের জন্যেই রুদ্র যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। রুদ্র ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-যুগ্ম সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব।
পরবর্তীতে তসলিমা নাসরিনের সাথে তার প্রেম, বিয়ে, ৬ বছর পর বিবাহ বিচ্ছেদ, তসলিমার রুদ্রর প্রতি আনা অভিযোগ, সে এক বড় ইতিহাস। বিচ্ছেদের পরের ইতিহাস আরো করুন।
রুদ্রর জীবন নিয়ন্ত্রিত ছিল না। শরীরের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করতেন। তুখোড় ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। গুরুত্ব তিনি কখনোই দেননি এসবকে। অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-তে। এ সময়টায় তিনি অনেক নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
বিকেলে অসীম সাহার প্রেসের আড্ডাটি জমে উঠতো। এখানে যোগ দিতেন কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, চিত্রকর সমর মজুমদার, সঙ্গীতশিল্পী কিরণচন্দ্র রায়, কবি কাজলেন্দু দে প্রমুখ। একদিন এই আড্ডাতে রুদ্রকে আর উপস্থিত পাওয়া যায়নি। অসীম সাহার কাছ থেকেই সবাই জানতে পারেন রুদ্র পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে হাসপাতালে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ২৩১ নাম্বার কেবিনে অসুস্থ রুদ্রকে দেখতে যান অনেকেই। হাসপাতালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংবাদিক আবু মাসুম মাসিক নান্দনিক পত্রিকায় লিখেন-
“আমার হাতে রজনীগন্ধার ডাঁটি দেখে রুদ্রর চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দেখি, পাশে বসে আছেন আহমদ ছফা। রুদ্রর এক হাত জড়িয়ে রেখেছেন তার হাতে। কথা বলছিল অল্প অল্প, মৃদুস্বরে। আহমদ ছফা বেরুনোর সময় রুদ্রর মাথায় হাত রেখে বললেন- তুমি তো ভালো হয়ে গেছো। আমি আবার আসবো। যাওয়ার সময় আহমদ ছফা একটা ইনভেলাপ রেখে গেলেন রুদ্রর বালিশের নিচে।”
হাসপাতালে সপ্তাহখানেক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০ জুন রুদ্র বাসায় ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন, ১৯৯১ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে কবি বেসিনে দাঁড়ান। হঠাৎ মুখ থুবড়ে বেসিনের উপরেই পড়ে যান। সিরামিকের বেসিন কবির ভার বইতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। কবির ভাই ডক্টর মুহম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
রুদ্রর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুষড়ে পড়েন দেশে ও দেশের বাইরে থাকা কবির বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। তার মতো কবি আরো বেচে থাকলে বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি কিছু দিতে পারতেন।
তবে তিনি আরো অনেক তরুন সাহিত্যিককে পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী একটি দেশে সুস্থ সাহিত্য চর্চায় তার ও আহমেদ ছফার মত লেখকদের ভুমিকা অনস্বীকার্য।
No comments