TjT

করনা প্রতিরোধে হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন। অপরিষ্কার হাত দিয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ্ করা থেকে বিরত থাকুন। অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতের তালুতে নিয়ে ( 20 সেকেন্ড ) ভাল করে পরিষ্কার করুন। ব্যবহৃত টিস্যু ঢাকনা যুক্ত ডাস্টবিনে ফেলুন। পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির সাথে হাত মেলানো বা আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকুন। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।

দ্বিতীয় বিবাহ ও সম্পর্ক


দ্বিতীয় বিবাহ ও সম্পর্ক



tjt79.blogspot.com





পর্ব ১



আজকে আমার স্বামী আমার আপন খালাত বোনকে ২য় বিবাহ করতেছে।বিয়েটা আমার সম্মতিতেই হচ্ছে।এমনটা না যে আমি আমার স্বামীকে জোর করে বিয়ে করতে বলেছি আর সে করছে।বিষয়টা এমন যে আমার স্বামী আর আমার সম্মতিতেই বিয়েটা হচ্ছে।


আমি সাদিয়া বয়স ২৯।অনার্স কমপ্লিট করার পরপরই বিয়েটা করেছি।আমাদের প্রেমের বিয়ে।প্রেমটা প্রণয়ে রূপ নেয় ২০১৬ সালে।এর আগে আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল।প্রথমে আমার পরিবার আপত্তি করলেও আমাদের একনিষ্ঠ জোরাজোরিতে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।


২০১৬ সালের মার্চ মাসের কথাটা কখনও ভুলব না।সেদিন আমি আমার ভালোবাসার মানুষ রাজিবকে আপন করে পেয়েছিলাম।


(রাজিব আমার স্বামী যার আজকে আমার খালাত বোনের সাথে।রাজিব একটা সরকারি কর্মকর্তা বয়স ২৯।আমার সমবয়সী।)


যাইহোক এবার ঘটনাই আসা যাক।রাজিবের সাথে বিয়ের পর থেকেই আমাদের জীবনটা একদম বদলে গেল।রাজিবকে পেয়ে আমি খুব খুশি ছিলাম।রাজিব আমার ভালো লাগা, খারাপ লাগা সবকিছুর খেয়াল রাখত।রাজিব ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।ভালোবাসা, রাগ অভিমান, খুনসুটির মধ্য দিয়েই বিয়ের ২ বছর পার করলাম।বিয়ের ২ বছর পর আমার খুশিটা আরও দ্বিগুণ হয়ে যায় এ কারনে যে আমি মা হতে চলেছি খবরটা নিশ্চিত হতে পেরে।সেদিন রাজিবের মুখেও এতটা খুশি ছিল যে তাকে দেখে মনে হয়েছিল যে আমি তাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিতে চলেছি।ইশ কি যে মুহূর্ত ছিল সেটা এখনও মনে হলে চোখের কোণে আনন্দ অশ্রূ বেয়ে পড়ে।


কিন্তু সে আনন্দটা ফিকে হয়ে যায় মাস তিনেক পরেই।কারন আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়।কেন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেটার কারনটা আমি জানি না।কারন ডাক্তার সমস্ত কিছু রাজিবকে বলেছিল।আমার মন খারাপ হবে বলে রাজিব আমাকে কোন কারন বলে নি।সেদিন আমার বাচ্চাটার জন্য আমি যতটুকু কেঁদেছিলাম জানি না তার চেয়ে ও বেশি কেঁদেছিল আমার স্বামী।তার কান্না দেখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।


কিন্তু কান্নার মাত্রাটা আরও প্রবল হল তখন যখন জানতে পারলাম আমি আর কখনও মা হতে পারব না।আমার মা হওয়ার ক্ষমতা চলে গিয়েছে।তখন এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম রাজিবের কথা ভেবে যে আমি আর কখনও রাজিবকে সন্তান দিতে পারব না।রাজিব সেদিন কষ্টটা প্রকাশ না করলে মুখটা দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পেয়েছে। রাজিবের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না।নিজেকে শাত্ত্বণা দেওয়ার ভাষা তখন ছিল না।


কষ্ট সুখের মধ্য দিয়েই সময়ের পরিক্রমায় একটা বছর পার করে ফেললাম।তবে মা না হতে পারার যন্ত্রণাটা কোনভাবেই পিছু ছাড়ছিল না।সারাক্ষণ একটা কষ্ট বুকে জমা থাকত।রাজিব অবশ্য তার কষ্টটা আমার কাছে প্রকাশ করত না।সবসময় আমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করত তবুও নিজেকে শূন্য মনে হত কারন আমি বউ হিসেবে তাকে একটা বাচ্চা কখনও দিতে পারব না।একদিন রাতে যখন হাউমাউ করে কেঁদে রাজিবকে বলি


-আমি তো তোমাকে কোনদিন ও বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারব না।আমাকে ক্ষমা করে দিও।আর তুমি আরেকটা বিয়ে করে নিও।


রাজিব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথার চুল আলতো করে টেনে টেনে বলল


-আমার এতকিছু লাগবে না।আমার পাশে তুমি থাকলেই হবে।আর তোমাকে রেখে আরেকটা বিয়ে করব ভাবলে কি করে।আজকে তোমার সমস্যা হয়েছে।আজকে তোমার জায়গায় যদি আমার সমস্যা হত তখন কি করতে?পারতে আমাকে রেখে আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করতে।ভালোবেসে তোমাকে বিয়ে করেছি। আমার জান পাখিটার জন্য এর থেকে কঠিন কিছু হলেও মেনে নিতে পারব। নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারব।


এ কথা শুনে আমি রাজিবের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম


-আমার জন্য তোমাকে জীবন দিতে হবে না।তুমি আমার জন্য যা করেছ এতেই আমি খুশি।আর আল্লাহ যেন আমার সব হয়াত তোমাকে দিয়ে দেয়।আমি তোমার কোলে মরতে চাই।আমি যে তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।


রাজিব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল


-আরে পাগলিটা আমরা দুজন দুজনের সঙ্গী।দুজন কে যেন আল্লাহ একসাথে পরপারে নিয়ে যায়।এবার যাও তো ঘুমাও।এত রাত জাগলে হবে নাকি।সকালে অফিস যেতে হবে না।


আমি হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম


-হুম ঘুমাচ্ছি তো।


রাজিব আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।কখন যে রাজিবের আদর মাখা হাতের স্পর্শে ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম টেরেই পেলাম না।ঘুম ভাঙ্গল খালামনির কলে।এত সকালে খালামনি কেন কল দিয়েছে বুঝতে পারলাম না।যদিও আত্নীয় স্বজনের কোন ঝামেলা হলে সবার আগে আমাকে কল দিয়ে জানানো হয়।তা অবশ্য দুইটা কারনে ১)আমি সবাইকে সৎ পরামর্শ দেই। ২)আমি যতটুকু পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি।


যাইহোক খালার কলটা রিসিভ করার সাথে সাথে খালা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল


-হ্যালো সাদিয়া তোর সাথে একটু কথা ছিল তুই কি ফ্রি আছিস।


খালার এরকম আতঙ্ক মাখা গলা শুনে আমি বেশ ভয় পেয়ে খালাকে বললাম


-খালা কি হয়েছে।এত ভয় পেয়ে কথা বলছ কেন?আমাকে বল কি হয়েছে।


খালা ওপাশ থেকে তৃণা নামটা বলেই বেশ কাঁদতে লাগল


(তৃণা আমার খালাত বোন।যার সাথে আজকে রাজিবের বিয়ে হচ্ছে।অনার্স কমপ্লিট করেছে।দেখতে আমার চেয়েও হাজারগুণ সুন্দরী আর স্মার্ট।দুঃখের বিষয় এই যে, আমার বিয়ের ২ বছর পরেই জানতে পারি তৃণা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।অনেক চিকিৎসা করেও সুস্থ হয় নি।)


যাইহোক খালার কান্নার আওয়াজটা ফোনে বেশ জোরালোভাবে শুনা যাচ্ছিল।আমি খালাকে শান্ত গলায় বললাম


-খালা কান্না থামিয়ে বলুন তৃণার কি হয়েছে।আপনি কান্না করলে তো আমি কিছুই বুঝতে পারব না।খালা দয়াকরে কান্না করবেন না।আমাকে খুলে বলুন তৃণার কি হয়েছে?


খালা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল


-তৃণা প্র্যাগনেন্ট।


কথাটা শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়লাম।কারন তৃণা অবিবাহিত।আর এরকম মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ের সাথে কে এমন করল।কত নীচু মনের হলে একটা মানুষ এমন করতে পারে।খালাকে কান্না থামিয়ে বলতে বললাম যে


-খালা কি হয়েছে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলুন


খালা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল


-রাত ১২ টার দিকে তৃণার অনেক পেট ব্যাথা শুরু হয়।তৃণাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে তারা একটা আল্ট্রা করতে বলে।আল্ট্রা করার পর জানতে পারি যে তৃণার পেটে দেড় মাসের বাচ্চা। তৃণাকে অনেক বার জিজ্ঞেস করলাম।বুঝাতে চেষ্টা করলাম তার সাথে কিছু হয়েছে কি না।কিন্তু তৃণা কিছুই বলতে পারছে না। মা তুই একবার বাসায় আয়।আমার কিছুই ভালো লাগছে না।সমাজে মুখ দেখাতে পারব না এমন কিছু হলে।মরা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই।


আমি ফোনটা রেখে রাজিবকে সবটা বললাম।রাজিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল


-এর সাথে কে এমন করল।সাদিয়া তুমি এক্ষুণি যাও।আমার পরিচিত একজন ডাক্তার আছে তার কাছে নিয়ে দেখ বাচ্চাটা নষ্ট করা যায় কি না।এছাড়া তো আর কোন উপায় দেখছি না।আমি ডাক্তারকে ফোন করে দিচ্ছি।


এ বলে রাজিব ডাক্তারকে ফোন করল।আর আমি সময় নষ্ট না করে সরাসরি খালার বাসায় চলে গেলাম।খালার বাসায় গিয়ে তৃণার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-আমার লক্ষী আপু।তোমার সাথে কেউ কি কিছু করেছে।


কিন্তু তৃণা আমার কথার মানেই বুঝতে পারছিল না।বারবার জিজ্ঞেস করার পরও কিছুই বলতে পারছিল না।খালাকে বললাম


-খালা বাচ্চা নষ্ট করা ছাড়া তো কোন উপায় দেখছি না।রাজিব একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।আমি তৃণাকে ঐখানে নিয়ে যাই কি বলেন?


-সাদিয়া তুই আমার শেষ ভরসা।আত্নীয়স্বজন কেউ জানে না।এর আগে যা করার কর।না হয় আমার মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে।


আমি কথা আর সময় না বাড়িয়ে তৃণাকে নিয়ে চলে গেলাম ডাক্তার কোমলের কাছে।ডাক্তার কোমল আমারও চিকিৎসা করেছিল।ডাক্তার কোমল তৃণাকে চেক-আপ করার পর বললেন


-দেখুন মিসেস সাদিয়া।এখন যদি আপনার বোনকে অ্যাবর্সন করানো হয় তাহলে আপনার বোনের প্রাণের ঝুঁকি আছে।আপনি কি করবেন ভেবে দেখুন।৫০/৫০ চান্স।


আমি একথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে বললাম


-থাক এ ঝুঁকি নিয়ে কিছু করতে হবে না।


তৃণাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।বাসায় আসার পর খালাকে বলার পর খালা বলল


-মরে গেলে মরে যাক।এরে নিয়ে কই যাব আমি।আমার মানসম্মান কিছু থাকবে না।আমি এখন আত্নহত্যা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।


-খালা এসব কিছুই করতে হবে না দেখা যাক কি হয়।আপনি স্থির রাখুন নিজেকে কালকে এসে দেখি কিছু করতে পারি না।


খলাকে কোনরকম শাত্ত্বণা দিয়ে খালার বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে আসলাম।ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়।রাজিব বাসায় আসার পর রাজিবকে ঘটনা বললাম।রাজিব আমাকে আমতা আমতা করে বলল


-তুমি যদি কিছু না মনে কর আমি একটা কথা বলব।


-হ্যা বল।এতে এত আমতা আমতা করার কি আছে?


রাজিব ভয়ে ভয়ে বলল


-সাদিয়া আমাদের তো একটা বাচ্চা নেই।আমরা যদি তৃনাকে এখানে এনে রাখি আর তৃণার বাচ্চাটাকে নিজের করে নেয় তাহলে কেমন হয়।


বাহ এভাবে তো ভেবে দেখি নি।রাজিবের বুদ্ধিটা বেশ ভালোই লাগল।কিন্তু বিয়ে বহির্ভূত তৃণাকে এখানে রাখলে আত্নীস্বজনের হাজারটা উত্তর দিতে হবে এ বাচ্চা কার এটার জবাব দিতে।কিন্তু তৃণাকে যদি রাজিবের বউ করে আনি তাহলে কেউ এমন প্রশ্ন উঠাতে পারবে না।আর তৃণাও আমার কাছে ভালো থাকবে।এমনিতেও অন্য কোন মেয়ে বিয়ে করালে রাজিবকে হারানোর ভয় ছিল।কিন্তু তৃণাকে বিয়ে করালে রাজিব ও আমারেই থাকবে।অনেক ভেবে চিন্তায় রাজিবকে বললাম


-তা আনা যায় তবে তৃণাকে তোমার বিয়ে করতে হবে।না হয় সবাই বিষয়টা খারাপ চোখে দেখবে। এছাড়া তোমার উপরও অবৈধ সম্পর্কের আঙ্গুল উঠবে।আমার মনে হয় তুমি তৃণাকে বিয়ে কর।


রাজিব একথা শুনে প্রথমে রাজি হল না।পরে আমার যুক্তি শুনে রাজি হল।আমারও বেশ শান্ত লাগল মন এটা ভেবে যে রাজিবকে একটা বাচ্চা তো দিতে পারব এবার।যার বাচ্চায় হোক মা ডাক তো শুনতে পারব।


পরদিন সকালে খালার বাসায় চলে গেলাম।খালাকে আমার প্রস্তাবটা শুনালাম।খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল


-আজকে তুই আমার জন্য আর নিজের বোনের জন্য যা করেছিস আর কোনদিন ভুলব না।


আত্নীয়স্বজন জানানো হল।সবাই রাজি হল।কারন তৃণা মানসিক ভারসাম্যহীন এতে করে আামার সংসার ও নষ্ট হবে না।তৃণাও ভালো থাকবে আর আমিও।যাইহোক বিয়ের দিন ঠিক করা হল।


অতঃপর আজকে বিয়ে সম্পন্ন হল।তৃণাকে লাল টুকটুকে বউ করে সাজিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসলাম।


তৃণাকে একটা রুমে বসিয়ে........





পর্ব-২





তৃনাকে বসিয়ে রাজিবকে ডেকে বললাম


-রাজিব তৃণাকে পাশের রুমে রেখে এসেছি। যাও ওর সাথে গিয়ে দেখা কর।


কথাগুলো বলতে যদিও কষ্ট হচ্ছিল।কারন বাঙ্গালি নারী আর যাইহোক স্বামীর ভাগটা দেওয়ার বেলায় খুব কিপ্টামি করে।কিন্তু যত যাইহোক এখন তৃণাও রাজিবের স্ত্রী আর রাজিবেরও তৃণার প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়েছে।নিজের বোনকে তো আর ঠাকতে পারি না।তাই রাজিবকে কথা গুলো বলে নীরব হয়ে গেলাম।রাজিব হয়ত আমার মনের ভাষাটা বুঝে ফেলেছিল।আমার মনের ভাষাটা বুঝতে পেরে রাজিব আমার হাতটা টেনে কাছে নিয়ে আসল।একদম তার বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। আর বলল


-সাদিয়া তুমি কি যে পাগলামি কর মাঝে মাঝে।পাগল একটা।


আমি বুকে কিল দিতে দিতে অভিমানী গলায় বললাম


-কেন কি করেছি?এমন বলছ যে।আমি কি কিছু ভুল বলেছি।


রাজিব আমাকে আরও শক্ত করে ধরে মাথাটা বুকের সাথে একদম মিশিয়ে বলল


-বোকা মেয়ে আমি তৃণার ঘরে কেন যাব?আমি তো তৃণাকে বিয়ে করেছি যাতে করে ওকে কেউ বদনাম দিতে না পারে।আর বাচ্চাটাও যেন আমাদের হয়ে যায়।শর্তসাপেক্ষে তৃণাকে বিয়ে করেছি।আর তৃণা তো মানসিক ভারসাম্যহীন ওর সাথে কিসের বাসর করব।কি যে হাবিজাবি কথা বল তুমি।আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।তোমাকেই কাছে পেতে চাই।আমার কাছে তুমি ছাড়া বাকিসব কিছুই না।বোকার মত কি যে বলে পাগলিটা।


আমার মনটা বেশ শান্ত হয়ে গেল।নিমিষেই যেন ভুলে গেলাম তৃণা আমার সতীন। কারন আমার রাজিব আমাকে ভুলে নি।আমার রাজিব আমাকেই ভালোবাসে আর বাসবে।আর রাজিবকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।


রাজিবের আলতো স্পর্শে আমার নিঃশ্বাসের শব্দ প্রখর হতে লাগল।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।হঠাৎ তৃণার চেঁচামেচিতে আমি রাজিবকে সরিয়ে তৃণার রুমের দিকে ছুটে গেলাম।গিয়ে দেখলাম তৃণা সব ঘর অগোছালো করে রেখেছে আমাকে দেখে তৃণা বলল


-কিরে আপু সবাই বলল আমার বর হয়েছে।আমার বর কোথায়?আমার বরকে এনে দাও। আমার বরকে কোথায় নিয়ে রেখেছ।আমি আমার বরের সাথে ঘুমাব।আমার বরকে না এনে দিলে সব ভেঙ্গে ফেলব।আমার বরকে এনে দাও


এই বলে আরও চেঁচামেচি করতে লাগল।আমার পরপরই রাজিব তৃণার ঘরে ঢুকল।রাজিবকে দেখে তৃণা দৌঁড়ে এসে ঝাপটে ধরল।আর বলল


-কি গো বর মশাই এতক্ষণ কোথায় ছিলে।তোমার জন্য কত অপেক্ষা করছিলাম।পচা আপুটা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিল না।পচা আপুটাকে বলত চলে যেতে।আমি তোমার সাথে ঘুমবা।


রাজিব তৃণার হাতটা ধরে বলল


-এই যে আমি চলে এসেছি।আমি তো তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট আনতে গিয়েছিলাম।


গিফটের কথা শুনে তৃণা গালে দুইটা হাত দিয়ে মুখটা বড় করে হা করে বলে উঠল


-বরমশাই কি সারপ্রাইজ এনেছ দেখাও তাড়াতাড়ি।


রাজিব তৃণাকে বলল


-সারপ্রাইজ তো সবার সামনে দিতে নেই।পরে দিব।


এরপর তৃণা আমার কাছে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল


-আপিটা যাও তো আমার বর আমাকে সারপ্রাইজ দিবে।তুমি থাকলে দিবে না।তুমি যাও তো আমার বরকে আমার কাছে থাকতে দাও।দেখেছ আপিটা আমার বর আমাকে কত ভালোবাসে।


রাজিব আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা দিল যেন রুম থেকে বের হয়ে যায়।কিন্তু আমার যেতে মন চাচ্ছিল না।কারন রাজিবের ভাগটা দিতে কষ্ট হবে আমার।যদিও তাদের মাঝে কোন সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।তবুও কেন জানি আমার রাজিবকে ছেড়ে যেতে ভালো লাগছে না।আমি রাজিবের ইশারা পেয়েও বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম।রাজিব আমার কাছে এসে আমার হাতটা ধরে দরজার কাছে গিয়ে জোরে জোরে বলল


-কি ব্যাপার বর আর বউ এর মধ্যে তুমি এসে দাঁড়িয়ে আছ যে।যেতে বলেছি তোমাকে। যাও তো।আমার তৃণা বউ তো এখন ঘুমিয়ে পড়বে।তুমি যাও তো।


কথাটা শুনে অনেক অবাক হলাম।রাজিব এমন কথা বলছে কি করে।ভিতরটায় যেন একটা দমকা বাতাস বইতে লাগল।সবকিছু যেন এলোমেলো করো দিচ্ছিল।


কিন্তু হঠাৎ রাজিব আমার কানের কাছে এসে বলল


-আমি তৃণাকে সামলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসছি তুমি যাও।না হয় এ পাগলি ঝামেলা বাড়াবে আরও।


রাজিবের এ কথাটা শুনে মনটা বেশ শান্ত হয়ে গেল।মনের ঝড়টা যেন কমে গেল।আমি রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে গেলাম।পাশের রুমে গেলেও আমার কানটা রয়ে গেল এ রুমে।যদিও আড়ি পেতে শুনা উচিত না তবুও শুনতে লাগলাম।কিন্তু সবকথা স্পষ্টভাবে শুনা যাচ্ছিল না।তবে তৃণা হঠাৎ জোরালো গলায় বলল


-বর মশাই দরজাটা লাগিয়ে দাও তো।এ ঘরে শুধু তুমি আর আমি থাকব।দরজা লাগিয়ে দাও।


কথাটা শুনে যেন বাম বুকে ব্যাথা অণুভব হল।নাহ এ আমি কি করছি?রাজিব তৃণার ও স্বামী।তৃণার অধিকার আছে রাজিবকে পাওয়ার।আমার তো এতে এত অস্থির হওয়া উচিত না।কেন আমি এমন করছি।এসব ভাবতে ভাবতে মনটা শান্ত করলাম।দরজা লাগানোর শব্দটা শুনে যেন শান্ত মনটা আরও অশান্ত হয়ে গেল।ছটফট করতে লাগলাম।আর ভাবতে লাগলাম।রাজিব কি তৃণাকে আদর করছে ঘরের ভিতরে।আমার রাজিব তৃণাকে পেয়ে আমাকে পর করে দিবে না তো।আমার রাজিব আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তে।ধুর এ আমি কি ভাবছি রাজিব আমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা তো একটু আগেই বুঝতে পেরেছি।রাজিব আমাকে ছেড়ে কখনও যাবে না।আর রাজিব তো তৃণাকে বিয়ে করতে তেমন রাজি ছিল না।দয়া করে তৃণার ভালোর জন্য বিয়েটা করেছে।আর ওদের মধ্যে হলেই বা কি ওরা স্বামী স্ত্রী তৃণার জায়গায় অন্য কেউ আসলেও তো আমার এর থেকে বেশি কষ্ট হত।তৃণা তো আর আমার রাজিবকে কেড়ে নিবে না।এসব ভেবে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই।তারচেয়ে বরং ঘুমিয়ে পড়ি। সারাদিন যে ঝামেলা গিয়েছে।তারচেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাই ভালো।আর মেনে নেওয়া শিখতে হবে।মনকে বুঝাতে হবে আমার রাজিব এখন শুধু আমার না তৃনারও।


ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু কোনভাবেই ঘুমাতে পারছিলাম না।এক কাঁত থেকে অন্য কাঁত হতে লাগলাম।পাশের রুম টাও বেশ নিস্তব, কোন আওয়াজ আসছে না।এ পাশ ওপাশ করতে করতে ঘড়ির কাঁটায় খেয়াল করলাম তিনটা বাজে।তবুও ঘুম আসছে না।হঠাৎ আমার রুমের দরজায় কিছু একটার আওয়াজ পেলাম।খেয়াল করে দেখলাম রাজিব।রাজিবকে দেখে মনে একটা প্রশান্তি আসল।আমি দৌঁড়ে গিয়ে রাজিবকে জড়িয়ে ধরে বললাম


-কেন জানি না একা থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।


রাজিব আমাকে ধরে বলল


-ধুর পাগলি আমি তো তোমারেই আছি।তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।ঘুমাও এবার।আমি ড্রেসটা একটু চেন্জ করি।


আলমিরা থেকে রাজিবের টি শার্ট এগিয়ে দিয়ে বললাম


-নাও চেন্জ করে নাও।আর ঘুমাতে আস।


রাজিব আমার হাত থেকে টি শার্ট টা নিয়ে যখন চেন্জ করার জন্য পাঞ্জাবি খুলল।আমি খেয়াল করলাম রাজিবের পিঠে আঁচরের দাগ।দাগটা একদম লাল হয়ে আছে।বুঝায় যাচ্ছে দাগটা মাত্র করেছে।আমার চোখটা দাগটায় আটকে গেল আর চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি বের হতে লাগল।তার মানে কি রাজিব তৃণার সাথে কিছু করছে আর তৃণা রাজিবের পিঠে আঁচড় বসিয়েছে।নাহ এ আমি কি ভাবছি আমার রাজিব এমন হতেই পারে না।আমি রাজিবের কাছে গিয়ে।লাল আঁচড় গুলায় স্পর্শ করে রাজিবকে জিজ্ঞেস করলাম


-আচ্ছা তোমার পিঠে এটা কিসের দাগ।তুমি কি তৃণার সাথে কিছু করেছ।


রাজিব আমার কথাটা শুনার জন্য মনে হয় প্রস্তুত ছিল না।রাজিব আমার কথাটা শুনে কিছুটা বিরক্ত হয়েছে তা বুঝায় যাচ্ছে।কারন রাজিবের মুখে বিরক্তের একটা ছাপ স্পষ্ট খেয়াল করলাম।বিরক্ত হয়েই বলল


-সাদিয়া এমন কথা আমি তোমার কাছে আশা করি নি।তুমি জান তৃণা প্র্যাগনেন্ট এ অবস্থায় আমি ওর সাথে কিছু করব ভাবলে কি করে।আর তৃণাকে বিয়ে করেছি বউ করার জন্য না বাচ্চার বাবা হওয়ার জন্য।তুমিই আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করলে আর তুমিই এসব বলছ।আমি তোমাকে কতবার বুঝাব।আমার প্রতি কি তোমার কোন আস্থা নেই সাদিয়া।মনে অনেক কষ্ট পেলাম।তোমার এমন কথা শুনে।


রাজিবের কথা শুনে মনে হল সত্যিই তো রাজিব তো কোন ভুল বলে নি।আমি তাহলে রাজিবকে কেন ভুল বুঝলাম।আমি রাজিবকে মাথা নীচু করে বললাম


-পিঠে এরকম দাগ দেখলাম তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি ভুল বুঝ না আমায়।আমি ঐভাবে কিছু বলতে চাই নি।


রাজিব বিরক্ত গলায় বলল


-পিঠের দাগটা তৃণায় করেছে।ঘুমাতে চাচ্ছিল না।জোর করে ঘুম পাড়াতে নিয়েছিলাম তাই দাগ বসিয়ে দিয়েছে খামচি দিয়ে।তৃণা যে কোন স্বাভাবিক মেয়ে না সেটা নিশ্চয় জান?এবার অন্তত বিশ্বাস বাড়াও।ভালোবাসার আগে বিশ্বাসটা জরুরি।


এ বলে রাজিব বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।সত্যিই তো আমি রাজিবকে একটু বেশিই সন্দেহ করে ফেলতেছি।এমনটা করা আমার উচিত হয় নি।কারন রাজিব আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে।আমি দৌঁড়ে গিয়ে রাজিবের পাশে শুয়ে রাজিবকে ধরে বললাম


-আমার এমনটা বলা উচিত হয় নি।দয়াকরে রাগ কর না।


রাজিব আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল


-আমি তো তোমার প্রতি রাগ করে থাকতে পারি না।এবার ঘুমাও।আমি ঘুমাব প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।এ বলে রাজিব আমার মাথাটা তার হাতে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখল।


আস্তে আস্তে আমার চোখ গুলা ঘুমের রাজ্যে চলে গেল।সকালে উঠেই রান্না বান্না শেষ করে রাজিবকে নাস্তা দিলাম।আর রজিব নাস্তা খেয়ে অফিস চলে গেল।আর আমি তৃণার রুমে গেলাম।খেয়াল করলাম তৃণা বসে আছে।তৃনার কাছে যেতেই তৃনা বেশ লজ্জামাখা মুখে বলল


-আমার বরটা অনেক দুষ্ট আমার বরটা কোথায় আপি


আমি চাপা গলায় জাবাব দিলাম


-অফিসে গিয়েছে।তুমি আস খাবি চল।


এ বলে তৃণার হাতটা ধরে যখন টান দিলাম তখন খেয়াল করলাম


পর্ব -৩




এ বলে তৃণার হাত ধরে যখন টান দিলাম তখন খেয়াল করলাম।তৃনার হাতে একটা চকচকে পাথরের আংটি বাইরের সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠছে।তৃণার হাতের আংটিটা দেখে অনেকটা অবাক হলাম।কারন তৃণার হাতে আগে এ আংটিটা ছিল না।তাহলে আংকটিটা কোথায় থেকে আসল।আংটিটা ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম এটা আমার আংটি যেটা আমাকে রাজিব আমাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিল।কিন্তু এ আংটিটা তো আলমিরাতে ছিল।তাহলে তৃণার হাতে আসল কি করে।আমি কিছুটা অবাক হয়ে তৃণাকে জিজ্ঞেস করলাম


-তৃণা তোমার হাতের আংটিটা অনেক সুন্দর কে দিয়েছে শুনি।


খেয়াল করলাম তৃণা আমার কথা শুনে বেশ লজ্জা পাচ্ছে।লজ্জায় মাথা লুকাতে চাচ্ছে।শাড়ির আঁচল টেনে মুখ ঢাকছে।আমি তৃণাকে আবার একটু ধাক্কা দিয়ে বললাম


-কি হল তৃণা বলছ না যে।এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?বল এ আংটি কে দিয়েছে?


তৃণা লজ্জামাখা মুখে হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে বলল


-বলব না লজ্জা লাগে।


আমি তৃণার হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে তৃণার দিকে তাকিয়ে বললাম


-আরে বোকা লজ্জা পাওয়ার কি আছে।আমি তো তোমার বোন।আর বোনদের কাছে সব শেয়ার করতে হয়।


তৃণা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল


-সত্যিই কি বোনদের সাথে সব শেয়ার করতে হয়।


-হ্যা তৃণা।মিথ্যা কেন বলব।বল না এ আংটি কে দিয়েছে?


তৃণা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে বলল


-এ আংটি আমার বরমশাই দিয়েছে।তুমি আবার কাউকে বল না।সারপ্রাইজ দিয়েছে তো। আর সারপ্রাইজ এর কথা কাউকে বলতে হয় না আমার বরমশাই বলেছে।


রাজিব তৃণাকে আমার আংটি দিয়েছে সারপ্রাইজ হিসেবে কথাটা শুনার পর মনে হল আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।আমার আংটি আমাকে না জিজ্ঞেস করেই তৃনাকে দিয়ে ফেলল।কলিজাটা ভেদ করে একটা তীর যেন কলিজাটাকে দুই ভাগ করে দিল।কি যে কষ্ট হচ্ছে।আমার রাজিব হয়ত পর হয়ে গিয়েছে।রাজিব এমনটা করতে পারল।কিন্তু আমি নিজেই তো রাজিবকে বিয়ে করার কথা বলেছিলাম।তাহলে এখন মেনে নিতে এত কষ্ট কেন হচ্ছে।কেন আমি রাজিবের ভাগটা তৃণাকে দিতে পারছি না।


নাহ আমার তো এমনটা করা উচিত না। তৃণা রাজিবের স্ত্রী । তৃণার অধিকার আছে রাজিবের ভালোবাসা পাবার।যতই তৃণা মানসিক অসুস্থ হোক ওকে তো আমি এসব থেকে বঞ্চিত করতে পারি না।তবে কেন আমি এসব মেনে নিতে পারছি না।এসব মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে।কেন মনে হচ্ছে আমার রাজিব আমার না আমার রাজিব তৃণার হয়ে গিয়েছে।


এসব প্রশ্ন মনের ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগল।হঠাৎ তৃণা ধাক্কা দিয়ে বলল


-কি গো আমার ক্ষুধা লেগেছে খেতে দিবে না।আর শুন আমার চুলটা বাঁধতে পারছি না।চুলটা বেঁধে দিবে।


আমি তৃনার ধাক্কা খেয়ে আচমকা প্রশ্নের জগৎ থেকে বের হয়ে আসলাম।তৃণার চুলের ঝট ছাড়িয়ে তেল দিয়ে চুলটা যখন খোপা করার জন্য উপরে তুললাম।তখন তৃণার সাদা নরম ঘাড়ে লাল হয়ে থাকা কামড়ের দাগটা বেশ স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম।কামড়ের দাগটা দেখে এতটায় কষ্ট পেলাম যে বলার ভাষা পাচ্ছি না।তার মানে তৃণার সাথে গতকাল রাতে রাজিবে কিছু হয়েছ।আর এ কামড়ের দাগটাই তার প্রমাণ।কিন্তু রাজিব আমাকে অস্বীকার না করলেও পাড়ত।সত্যিটা বললে তো আমি ওকে কিছু বলতাম না।হয়ত মনে একটু কষ্ট পেতাম।এর বাইরে তো কিছু করতাম না।এত বড় মিথ্যা আমাকে না বুঝালেও পাড়ত।চোখের কোণে একটা ক্ষুদ্র অশ্রুবিন্দু জমা হয়ে বৃষ্টি হয়ে নেমে গেল।


কষ্টটা কোন রকম সামলিয়ে ব্যাপারটা আরও সিউর হওয়ার জন্য তৃণাকে বললাম


-আপুমণি আমার।তোমার ঘাড়ে এটা কিসের দাগ।


তৃণা হাসতে হাসতে বলল


-আমি বলব না।আমার লজ্জা লাগে।আমার বরমশাই বলেছে এসব লজ্জার কথা কাউকে না বলতে।আমি বলব না।হিহিহিহিহি।


আমি তৃণাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললাম


-আমি তো তোমার বোন আমার কাছে বললে কিছু হবে না।তোমার বরমশাই তোমাকে অন্যদের কাছে বলতে নিষেধ করেছে।কিন্তু বোনের কাছে সব বলা যাবে।বল না এটা কিসের দাগ।


তৃণা লজ্জা মাখা মুখে চোখ বন্ধ করে বলল


-আমার বরমশাই আমাকে কামড় দিয়েছে।আমি তো ব্যাথা পেয়ে আমার বরমশাইকে মারতে গিয়েছিলাম।তখন আমার বরমশাই বলল।এটা কামড় না এটা আদর।আর বউদের নাকি এভাবে আদর করতে হয়।তাই আমিও আমার বরমশাইকে পিঠে কামড় দিয়ে আদর করে দিয়েছ।হিহিহিহি।আর বলব না লজ্জা লাগে আমার।আচ্ছা তুমি আমার বরমশাইকে বলে দিবে না তো।তাহলে আমার বরমশাই কিন্তু রাগ করবে।আমাকে আর বদর করবে না।


তৃণার কথা শুনে বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছিল।আমার রাজিব আমার সাথে ছলনা করা শুরু করল।তৃণার সাথে এতকিছু করেও অস্বীকার করল।কিভাবে পারল আমার রাজিব আমাকে ঠকাতে।আমার সব মানতে কষ্ট হত কিন্তু রাজিব আমাকে মিথ্যা না বললেও পাড়ত।চোখ দিয়ে অজোরে জল পড়তে লাগল।হুট করে তৃণা ধাক্কা দিয়ে বলল


-আপিটা কাঁদছ কেন?তোমার বর বুঝি তোমাকে আদর করে না।আচ্ছা কেঁদো না।তোমার বর তোমাকে আদর করবে।কিন্তু আমার বরমশাইকে এসব বল না আমি যে তোমাকে বলেছি।


আমি তৃণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম


-আরে বলব না।চল এবার খেতে চল।


অতঃপর তৃণাকে খাওয়ালাম।তারপর রুমে গিয়ে বসে জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম।আজকের আকাশটা বেশ অচেনা আর শূণ্য লাগছে।এতটা বিবর্ণ আকাশ হয়ত আমি কখনও দেখি নি।হয়ত আমার মনটায় বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে তাই আকাশটা এমন লাগছে।সারাটাদিন শুধু তৃণা আর রাজিবের কথা ভেবে পার করলাম।সন্ধ্যায় রাজিব বাসায় ফিরল।রাজিব ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকার পর জিজ্ঞেস করলাম


-তুমি তৃণাকে আমার আংটি দিয়েছ কেন?আমাকে না জানিয়ে আমার আংটি তুমি তৃণাকে দিয়েছ।একটা নতুন আংটি কিনে দিলেই পারতা।


রাজিব আমার অভিমাণী গলা শুনে বলল


-আরে বোকা মেয়ে তখন পাগলিটা যেভাবে ক্ষেপেছিল তাকে সামলানোর জন্য এ কাজ করেছি।আর তুমি ঐ রুমে ছিলে তাই তোমাকে বলার সুযোগ পাই নি।


আমি কর্কশ গলায় বললাম


-রাতে যখন এসেছিলে তখন বলতে পারতে।তখন বল নি কেন?


রাজিব রাগ হয়ে জাবাব দিল


-দেখ সাদিয়া তখন কি তুমি এতকিছু বলার মত পরিস্থিতি রেখেছিলে।তুমি আমাকে তৃণাকে নিয়ে সন্দেহ করে যাতা বলতেছ।আমি কিন্তু এসব মেনে নিব না।আর তৃণা তো কোন পরনারী না।কাগজে কলমে আমার বউ। তোমার ইচ্ছাতে বিয়ে করেছি তাহলে তৃণার সাথে কিছু হলে তো তোমার আপত্তি থাকার কথা না।আর তুমি ইদানিং অনেক সন্দেহবাদী হয়ে যাচ্ছ।এসব ছাড় সাদিয়া।আমাকে আমার মত থাকতে দাও।আর চার্জ কর না প্লিজ আমি নিতে পারছি না।আর তৃণার সাথে আমার কিছু হয় নি।


রাজিবের কথাগুলো শুনে অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-সত্যিই তৃণার সাথে গতরাতে কিছু হয় নি তোমার?


-হ্যা সত্যি হয় নি।আর কিছু বলার আছে?


আমি চুপ হয়ে গেলাম।আর কোন জবাব দিলাম না।কামড়ের দাগের কথাও জিজ্ঞেস করলাম না।কারন এ কথা বললেও হয়ত হাজারটা বাহানা দেখাত।একদম চুপ হয়ে গেলাম।সব কাজ স্বাভাবিক ভাবে করে শুয়ে পড়লাম।ভাবছিলাম রাজিব হয়ত আমার মনের অবস্থা বুঝে আমার রাগ ভাঙ্গাবে।কিন্তু রাজিব আমার কাছেই আসল না।ও তৃণাকে নিয়েই ব্যাস্ত রইল।তৃণাকে খাওয়াল তারপর তৃণার সাথে গল্পে মেতে গেল।এদিকে যে আমি একজন মানুষ না খেয়ে পড়ে রইলাম তার খেয়াল সে রাখল না।কতটা চেন্জ হতে পারে মানুষ রাজিব না দেখলে বুঝতাম না।বিয়ের একদিনেই এমন হয়ে গেল।দোষটা কি আমার নাকি রাজিবের।আমি কি বাড়াবাড়ি করছি নাকি রাজিব আমাকে তৃণাকে পেয়ে সত্যিই অবহেলা করছে।ভাবনার কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না।খানিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম


পর্ব -৪





খাণিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম রাজিব আমার রুমে এসেছে।রাজিবকে দেখে মনের ভিতর একটা স্বস্তি কাজ করল।মনে হল রাজিব আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে।আর এখনি রাজিব আমাকে রাগ ভাঙ্গাতে আসবে।কিন্তু আশার আকাশটা চৌচির হয়ে নিরাশ হল যখন খেয়াল করলাম রাজিব আমার কাছে না এসে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ল।ভেবেছিলাম রাজিব হয়ত আমার কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমার পাখিটা কি রাগ করেছে।আমার পাখিটার কি আমার উপর বেশি রাগ হয়েছে।নাহ এর কিছুই রাজিব করল না।এক পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল।আর এদিকে আমার আমার বুকটা ফেটে দ্বিখন্ডিত হতে লাগল।এটা কি আমার সে রাজিব যাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি।যার সাথে তিনবছর সংসার করেছি।আজকের রাজিবকটাকে কেন আগের রাজিব ভাবতে পারছি না।কেন মনে হচ্ছে আমি যাকে ভালোবেসেছি সে রাজিব এটা না।চোখের জল আর কোন বাঁধা মানছে না।অনর্গল পড়তে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে হালকা ঘুৃমের ভাব আসল চোখে।খানিকক্ষণ এর জন্য চোখটা হয়ত বুজে ছিলাম।


খানিকক্ষণ পর জেগে খেয়াল করলাম,রাজিব আমার পাশে নেই।সারা ঘরে চোখ বুলালাম রাজিবকে পেলাম না।ঘড়ির কাটায় খেয়াল করলাম ভোর পাঁচটা বাজে।তৃণার ঘরের সামনে গিয়ে তৃণার ঘরটা খোলা পেয়ে ঢুকে যা দেখলাম তা দেখে কলিজাটা চৌচির হয়ে গেল।তৃণা অগোছালো অর্ধ উলঙ্গ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আর রাজিব পাশে শুয়ে আছে।তাদের দেখে কিছু না বলে বের হয়ে চলে আসলাম।


কিছুক্ষণ পর রাজিব ঘরে ঢুকল।রাজিবকে বললাম


-তুমি কি জাননা তৃণা অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় তুমি তৃণার সাথে এমন করতেছ।তোমার কি মাথা বিগড়ে গিয়েছে রাজিব?লজ্জা করল না তোমার এমন একটা কাজ করতে।আর কত নীচে নামবে?আমার সাথে এখন কি বলবে?আর কি নাটক সাজাবে শুনি।আজকে স্পষ্ট সবটা আমার নিজের চোখে দেখেছি।আজকে কি বলে শাত্ত্বণা দিবে শুনি।


রাজিব কর্কশ গলায় বলল


-শাত্ত্বণা কেন দিব তোমায়।তুমি আমায় বিয়ে করিয়েছ।আর তৃণা আমার স্ত্রী তার সাথে আমার সব হালাল।তুমি কোন যুক্তিতে এসব বলছ।বিয়েটা তো তোমার অণুমতিতে হয়েছে সাদিয়া।


রাজিবের কথাগুলো শুনে ভিতরটা কেঁপে উঠল।তৃণাকে পেয়ে রাজিব এতটা বদলে যাবে চিন্তা করি নি।আজকে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে যে আমি মানুষ চিনতে এতটা ভুল করেছি।রাজিবকে হাসতে হাসতে জাবাব দিলাম


-বাহ খুব ভালো উত্তর দিয়েছ।এতদিনের সম্পর্ক আমাদের।আমার থেকে এখন তৃণা বড় হয়ে গেল।তৃণাকে দোষ দিব না।সে তো মানসিক রোগী।দোষ দিব তোমার মত মুখোশধারী মানুষকে যে কিনা একটা মেয়ে পেয়েই রূপ বদলে ফেলেছে।তৃনাকে বিয়ের কথা তো আমি তোমার বুদ্ধিতে বলেছিলাম।হয়ত সেটাও তোমার ফাঁদ ছিল এখন বুঝতে পারছি সব।এতটা বোকা আমি কি করে হলাম।


রাজিব আমার গালে জোরে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল


-লজ্জা লাগে না এমন কথা বলতে?নিজের বোনকে আমার ঘাড়ে চাপিয়েছ।আর এখন বড় বড় কথা বলতেছ?লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।


চড়টা খেয়ে খুব স্তব্দ হয়ে গেলাম।ভিতরের আমিটার অস্তিত্বটা যেন নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল।এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বুঝতে পারি নি।কোনদিন রাজিব আমার গায়ে হাত তুলে নি।আর আজকে রাজিব আমাকে এভাবে চড়টা দিতে পারল।ভাবতেই যেন বুকের ভিতরটা কষ্টে ফেটে দুভাগ হয়ে গেল।


চোখের জল মুছে সরাসরি রান্না ঘরে চলে গেলাম।রান্না ঘরে গিয়ে রান্নায় মন বসাতে পারছিলাম না।তাই স্থির করলাম লটপটি খিচুরি আর ডিম ভাজি করব।এ বুদ্ধিটা অবশ্য রাজিব আমাকে শিখিয়েছিল।আমার যেদিন রান্না করতে ভালো লাগত না সেদিন রাজিব আমাকে লটপটি খিচুরি রান্না করে খাওয়াত।রান্নার পদ্ধতিটাও খুব সহজ


প্রথমে পরিমাণ মত পোলাও চাল নিয়ে ভালো করে ধুয়ে পানি জড়িয়ে নিতে হবে।তারপর একটা কড়াই নিয়ে চুলায় বসিয়ে হালকা তেল দিতে হবে।এতে হালকা গরম মসলা দিয়ে একটু ভেজে পোলাও চাল গুলো ছেড়ে দিতে হবে।তারপর পরিমাণ মত সকল প্রকার মসলা দিয়ে একটু ভেজে কষিয়ে নিতে হবে।তারপর পরিমাণ মত পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।আর পানি শুকিয়ে আসলে তুলে নিতে হবে।আর একটা ডিম ভাজা দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।


রান্নার রেসিপি খুব সহজ আর ঝামেলা মুক্ত হলেও খেতে কিন্তু দারুণ মজা।রাজিবের সাথে বিয়ের একমাস পর একদিন আমার প্রচুর খারাপ লাগছিল।রান্না ঘরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।বুঝতে পারছিলাম না কি করব।তখন রাজিব কি করে যেন আমার খারাপ লাগাটা বুঝতে পেরেছিল।পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল


-আমার বউটার বুঝি রান্না করতে ইচ্ছা করছে না?


আমি অবাক হয়ে রাজিবের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম


-তুমি জানলে কি করে?


রাজিব হাসতে হাসতে বলল


-আমার বউটার মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারি।তা কি করবেন এখন।


আমি বিরক্ত গলায় বললাম


-কি আর করব।রান্না করব।


(সত্যি বলতে ছোট বেলায় আমার মা মারা যায়।তাই রান্নার হাত কাঁচা।বাবার কাছে মানুষ।এ বাড়ি ঘর সবকিছু বাবা নিজের হাতে করেছে।এত সব সম্পত্তি শুধু বাবা আমার জন্য রেখে গিয়েছে।কাজের খালার কাছে বড় হয়েছি।জীবনে কখনও রান্না করে নি।অনার্সে উঠার পর রাজিবের সাথে পরিচয়।রাজিবের ও পরিবারে কেউ নেই।মামার বাসায় থেকে বড় হয়েছে।আমার বিয়েতে বাবা অনেক অমত করেছিল রাজিবকে নিয়ে তবে বিয়ের সাতদিন আগে উনি মেনে নেয়।আর আমাদের বিয়ে হয়।রাজিবের পরিবারে কেউ ছিল না তাই রাজিবকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকি।আর আমার বিয়ের ১০ দিন পর ব্যাবসায়িক কাজে বাইরে যায়।এরপর আর বাবা ফিরে আসে নি।কোথায় গিয়েছে জানি না।হয়ত খুব রাগ করে আছে।বিয়ের এক সপ্তাহ পর কাজের খালাটাও দেশে চলে গেল।এরপর শুরু হল আমার বই দেখে রান্না।অবশ্য তখন রাজিবকে যা রান্না করে দিতাম তাই খেত।)


যাইহোক ঘটনায় আসি।আমার বিরক্ত মাখা কন্ঠ শুনে রাজিব বলল


-থাক আজকে তোমার কষ্ট করতে হবে না আমি তোমাকে একটা সহজ রান্না শিখিয়ে দিচ্ছি।


আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-তুমি কবে রান্না শিখলে?


রাজিব হাসতে হাসতে বলল


-তেমন রান্না পারি না তবে লটপটি খিচুরি রান্নাটা ভালো পারি।দাড়াঁও তোমাকে শিখাচ্ছি।


এ বলে রাজিব রেসিপি বলে বলে রান্না করতে লাগল।সেই যে রাজিব রেসিপিটা বলেছিল তখনেই মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।আর এখন বিয়ের তিনবছরের মাথায় কোন রান্নায় বাকি নেই যে আমি পারি না।


যাইহোক আগের কথা মনে পড়ে চোখের কোণে একটু জল চলে আসল।আর আজকে সেই রাজিব আমার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করল না।হায়রে সময় কখন যে কার হয়ে যাও বুঝতে দাও না আগে।বুঝলে হয়ত এতটা কষ্ট সহ্য করতে হত না।


রান্না শেষ করে খেয়াল করলাম রাজিব রেডি হয়ে গিয়েছে।আমি রাজিবকে বললাম


-লটপটি রান্না করেছি তাড়াতাড়ি খেতে এস।


রাজিব রাগ হয়ে বলল


-তুমি কি আর খাবার গিলার পরিস্থিতি রেখেছ।আমার খাবার খাওয়ার মন নেই এখন।আমি অফিসে যাব। তৃনার খেয়াল রেখ।


এ বলে রাজিব বেরিয়ে গেল।কথাগুলো শুনে আজকে কেন জানি না আমার চেনা রাজিবকে বেশ অচেনা মনে হচ্ছে।কেন এমন করছে রাজিব।আমি কি বেশি বাড়াবাড়ি করছি নাকি রাজিব আমার সাথে সত্যিই খারাপ আচরণ করছে।কোনটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।


কিছু বুঝে উঠার আগেই তৃণার তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানে ভেসে আসল।বেশ চেঁচামেঁচি করছে মেয়েটা।দৌঁড়ে তৃনার কাছে গিয়ে বললাম


-কি হয়েছে তোমার এমন করছ কেন।


তৃনা আমাকে ঝাপটে ধরে বলল


-বরমশাই এর সাথে আমি আর থাকব না।


কিছুটা অবাক হয়ে তৃনাকে জিজ্ঞেস করলাম


-কিন্তু কেন?


তৃনা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় জাবাব দিল


-বরমশাই আমাকে জোর করে আদর করে।আমার একদম ভালো লাগে না।আমার খুব কষ্ট হয়।


তৃনার এ কথাটা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।কিছুটা ঘৃনাও হল রাজিবের প্রতি।সামান্য চাহিদার জন্য এত নীচে নামতে পারে আমি ভাবতেও পারছি না।তৃনা তো কষ্টটা শেয়ার ও করতে পারছে না।ইশ কত বড় অন্যায় আমি তৃনার সাথে হতে দিচ্ছি।এ আর হতে দেওয়া যাবে না।তৃনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম।


-আর কষ্ট করতে হবে না তোমাকে।চল এবার খাবে চল।


তৃনা হাসতে হাসতে আমার সাথে খাবার খেতে গেল।টেবিলে রাখা লটপটি খিচুরি দেখে তৃনার মুখে যেন খুশি উঁপচে পড়েছে।খুশি মাখা মুখে আমাকে বলল


-আপু আমাকে তাড়াতাড়ি দাও আমি এখনেই খাব সব।


আমি তৃনাকে খাওয়ালাম।সাথে একটা ডিম সিদ্ধ জোর করে খাওয়ালাম।কারণ এ সময় যদি না খায় বাচ্চা সুস্থ থাকবে না।তৃনার সব কাজ শেষ করে এবার ঘরে গেলাম।ঘরে গিয়ে খেয়াল করলাম..


পর্ব -৫




ঘরে গিয়ে খেয়াল করলাম জানালা দিয়ে হালকা বৃষ্টিকণা আসছে।জানালার কাছে গিয়ে বসলাম।আকাশটায় তাকিয়ে এক নিমিষেই অতীতে হারিয়ে গেলাম। তখন ও এরকম হালকা বৃষ্টি হত মাঝে মাঝে।আমি যেদিন প্রথম ভার্সিটি গিয়েছিলাম সেদিন ও হালকা হালকা বৃষ্টিফোটা পড়েছিল।গাড়ি থেকে ডিপার্টমেন্ট এ যেতে একটু হাঁটতে হত।আমি ডিপার্টমেন্ট এ যেতে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম।এবং অবশেষে ডিপার্টমেন্ট এ পৌঁছায়। এর মধ্যে হালকা ভিজে যাই।প্রথম দিন গিয়ে খেয়াল করলাম আমিই সবার পরে এসেছি।তাই একদম পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।সেদিন প্রথম রাজিবকে দেখি।রাজিব দেখতে অনেক সুন্দর ছিল।প্রথম দেখায় ভালো লাগা বলা যায়।রাজিবকে দেখে আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম রাজিবের দিকে।আমার তাকানো দেখে রাজিব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল


-আপনি কি কিছু বলতে চান?


আমি রাজিবের এমন প্রশ্নে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম।লজ্জা পেয়ে বললাম।


-নাহ মানে একটু বসতে চেয়েছিলাম।


সেদিন থেকেই আমাদের বন্ধুত্বটা শুরু।রাজিব পড়াশোনায় ছিল অনেক ভালো।তাই রাজিবের প্রতি ভালোলাগাটা আরও বেশি কাজ করত।আমি ছিলাম বরাবরের মত দুষ্ট স্বভাবের আর রাজিব ছিল শান্ত।রাজিবের সাথে কথা বলতে বলতে ভালোলাগাটা যে কবে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হল বুঝতেই পারলাম না।


ভার্সিটির বেস্ট কাপল ছিলাম আমরা।আমাদের বেস্ট কাপলের স্ট্যাটাসে মুখরিত থাকত ফেসবুকের নিউজফিড।কত ভালোবাসা আর আবেগমাখা দিন গুলো পার করেছি।আজ ও ভুলে নি। দৌঁড়ে গিয়ে মামার দেকানে ফুচকা খেতাম।রাজিবের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না।তাই কখনও তাকে নিয়ে বড় কোন রেস্টুরেন্টে যেতাম না।যদি সে লজ্জাবোধ করে তার জন্য।নিজেকে ওর মত করে গড়ে নিয়েছিলাম।গাড়ি ছেড়ে ওর সাথে বাসে যাতায়াত শুরু করেছিলাম।প্রেমের ৫ টা বছর পর রাজিবের একটা ভালো জব হয় আর আমি বাবার কাছে রাজিবের কথা বলি।রাজিবের আর্থিক অবস্থার জন্য বাবা রাজি ছিল না।তবে আমার জিদের কাছে বাবার রাগটা হার মেনে যায়।বাধ্য হয় আমাকে বিয়ে দিতে।আমার বাড়িতে আমি একা ছিলাম তার জন্য রাজিবকে আমার বাড়িতে থাকার জন্য রাজি করাই আর সেও রাজি হয়।


শুরু হয় আমাদের নতুন সংসার।পার করি তিনটা বছর।কখনও রাজিব আমাকে হাত তুলা তো দূরে থাক বকা পর্যন্ত দেয় নি।আর আজকে সেই রাজিব আমার সাথে এমন করছে।এতটা কষ্ট লাগতেছে বুঝাতে পারব না।হঠাৎ বজ্রপাতের আওয়াজে চমকে গেলাম।বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ঝড় হচ্ছে।জানালা আটকিয়ে দিয়ে নাস্তা না করেই মরার মত পড়ে রইলাম।সারাদিন এভাবেই গেল।দুপুরে বাহির থেকে খাবার অর্ডার করে তৃনাকে খাওয়ালাম।রাতে আর কিছু রান্না করে নি।তৃনার জন্য দুপুরের খাবার থেকে রেখে দিয়েছিলাম।


রাতে রাজিব আসল।আমাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখেও কিছু বলল না।সকালে তৃনার কথাটা আমার মাথায় বারবার বাজতেছিল।তাই রাজিব আসার সাথে সাথে রাজিবকে বললাম


-তোমার তৃনার সাথে নোংরামি করতে বিবেকে আটকাল না।তোমার এতই চাহিদা যে মানসিক বিকারগ্রস্ত একটা মেয়ের সাথে এমন কাজ করতে হবে।আর সে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট জানা সত্ত্বেও।আমি তৃনাকে বিয়ে করিয়েছি বাচ্চার জন্য।আর বাচ্চার কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না।এসব নোংরামি করার আগে ভেবে চিন্তায় করবে।না হয় আমি প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিব।আমাকে রাগানোর চেষ্টা করবে না আশা করি।


আমার কথাগুলোর কোন জবাবেই রাজিব দিল না।হয়ত রাজিবের কাছে এর উত্তরেই ছিল না।এরপর থেকে রাজিবের সাথে আমার সম্পর্ক টা তেমন ভালো যাচ্ছিল না।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারনেই রাজিবের সাথে আমার ঝগড়া লেগে যেত।রাজিব আগের থেকে অনেক বদলে গিয়েছে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম।ইদানিং তৃনার প্রতিও কোন টান রাজিবের কাজ করত না।আর এদিকে আমার ব্যাপারেও রাজিব উদাসীন ছিল।তৃনা আর আমি সারাটা দিন একা একাই পার করতাম।রাজিবের ইচ্ছা হলে বসায় খেত আর ইচ্ছা না হলে খেত না।বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকত।দেখতে দেখতে ৫ টা মাস কেটে গেল।সম্পর্ক টা আস্তে আস্তে তেঁতো হতে শুরু করল।সম্পর্ক টা আরও খারাপ হল তখন যখন আমি একটা কঠিন সত্য জানতে পারলাম।নিজের উপর নিজের ঘৃনা হতে লাগল।আমি মানুষ চিনতে এতটাই ভুল করেছিলাম।আর এমন একটা মানুষের হাতে নিজের বোনের জীবনটাও শপে দিয়েছি।এত বড় ভুলটা আমি কিভাবে করলাম।


কারন সেদিন তৃনার পেটে খুব ব্যাথা হচ্ছিল।প্রতিবারেই রাজিব তৃনাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।তৃনার চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব রাজিবেই পালন করে থাকে।সেদিন রাজিব বাসায় ছিল না।আর তৃনার ব্যাথাটাও বেশ তীব্র ছিল।সাত মাসে এমন ব্যাথা কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।রাজিবকে কল দিলাম।রাজিব ফোন তুলল না।বারবার ফোন করলাম কোন সাড়া পেলাম না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না।কোন দিশা না পেয়ে ডাক্তার কোমলকে কল করলাম।ডাক্তার কোমল ও দেড়ি না করে সাথে সাথে আমার বাসায় চলে আসল।


বাসায় আসতেই ডাক্তার কোমলকে দেখে তৃনা কোনভাবেই দেখাতে চাচ্ছিল না।কারন তৃনাকে রাজিব অন্য ডাক্তার দেখাত।তবুও জোর করে তৃনাকে দেখালাম।ডাক্তার কোমল তৃনাকে দেখল।আর আমাকে বলল


-ভয়ের কিছু নেই সব ঠিক আছে।আর রোগীকে পুরোপুরি রেস্টে থাকতে হবে।


আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।তৃনাকে রুমে রেখে ডাক্তার কোমলকে নিয়ে আমার রুমে গেলাম।ডাক্তার কোমল এবার প্রেসক্রিপশন লিখার সময় বলল


-রোগীর স্বামী কে?


আমি রাজিবের নাম বলাতে ডাক্তার কোমল বেশ অবাক হল।অবাক হয়ে আমাকে বলল


-আপনি তো মনে হয় এর আগে এ রোগীকে নিয়েই এসেছিলেন তাখন তো বলেছিলেন মেয়েটা অবিবাহিত।তবে আজকে স্বামীর নাম এমন বলতেছেন।আমার মাত্র খেয়াল হল।এ মেয়েই কি সে মেয়ে ছিল?


আমি মাথা নেড়ে বললাম হ্যা।ডাক্তার কোমল কিছুটা অবাক হয়ে বলল


-২য় বিয়ের কারন কি জানতে পারি??


আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম


-আপনি তো জানেনেই সব। আমার কখনও বাচ্চা হবে না।আর তৃনার এ অবস্থা। তাই একটা বাচ্চার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া।


ডাক্তার কোমল আমার একথাটা শুনে আরও অবাক হয়ে বলল


-বাচ্চা হবে না মানে কি?আপনার তো দুইটা বাচ্চা আছে তাই না?


আমি ডাক্তার কোমলের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দুইটা বাচ্চা আছে মানে এসব কি বলছে মাথায় ধরছিল না।তাই চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-আমি আপনার কথার মানে বুঝতেছি না।একটু বলবেন?


তখন ডাক্তার কোমল যা বলল তা শুনে আমি ভেঙ্গে পড়লাম।কারন ডাক্তার কোমল বলল


-আপনার বাচ্চাটা নষ্ট করানো হয়েছে।আপনার স্বামী আমাকে বলেছিল আপনার দুইটা বাচ্চা আছে।উনি আর বাচ্চা চান না।আমি যেন আপনাকে না জানিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করে দেই।আপনার শরীর ভালো থাকে না।অনেক বুঝাল।আমি সব শুনে মনে হল বাচ্চাটা নষ্ট করলে হয়ত আপনার ভালো বেশি হবে।তাই নষ্ট করে দেই এবং আমাকে বলা হয়েছিল টিউবাল লাইগেজশন যেন করিয়ে দেই।আমি তাই করিয়েছি এতে করে আপনার আর বাচ্চা হবে না।কিন্তু আজকে বললেন আপনি নিঃসন্তান আমি তো এর মানে বুঝতেছি না।আপনি নিঃসন্তান হলে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার কারন তো বুঝতে পারছি না।


ডাক্তার কোমলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম


-কোথাও ভুল হচ্ছে না তো আপনার?


ডাক্তার কোমল বললেন


-দেখুন এক বছর আগের কাহিনী ভুল কেন হবে?আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না।আপনি দয়াকরে আগের কাগজপত্রগুলো একটু খুঁজে বের করে দেখুন


এ বলে ডাক্তার কোমল চলে গেলেন।রাজিব আমার সাথে এমন করতে পারল।কিন্তু কেন?এত বড় অপরাধ রাজিব করতে পারে আমি ভাবতেই পারছি না।ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে।আমার জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে আসতে হবে তা কখনও ভাবতেও পারি নি।সময় মানুষের জীবনকে কতটা পাল্টে দেয় বুঝতে পারলাম এখন।"সময়ের মাপকাঠিতে মানুষের জীবনের অস্থিত্ব কখনও বিলীন হয়ে যায় আবার কখনও সেটা জেগে উঠে।পরিস্থিতিগুলো যদি সময়ের আগে টের পাওয়া যেত তাহলে মানুষের জীবন এতটা দুর্বিসহ হয়ে যেত না।সময় আর পরিস্থিতি সেটা যেন আপন মনে চলে।কেউ কারও জন্য বসে থাকে না।"কি এক পর্যায়ে এসে পড়লাম আমি।আজ নিজেকে বেশ অস্থিত্বহীন মনে হচ্ছে।সত্যিই কি রাজিব আমার সাথে এমন করেছে নাকি ডাক্তার কোমলের কথা মিথ্যা।"বিশ্বাসের জায়গাটা একটা কাচের দেয়ালের মত।একবার ফাটল ধরলে সেটা আর জোড়া লাগালেও দাগটা ঠিকেই থেকে যায়।সেই ভাঙ্গা কাচের দেয়ালের সামনে দাঁড়ালেও ঠিকেই মানুষের আঁকা বাঁকা প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।বিশ্বাসটাও তেমন একবার ভেঙ্গে গেলে তা ফিরে আসতে চায় না।আর ফিরে আসলেও সন্দেহটা রয়ে যায়।"কি করব? কাকে বিশ্বাস করব?আমি কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি।আমার ঘুমটা তাহলে যেন এখনেই ভেঙ্গে যায়।নাহ তো এটা বাস্তব। ভাবনার দেয়াল থেকে বের হতে পারছিলাম না।নিজেকেএকটু সামলে নিলাম।


তারপর সারা ঘর তন্ন তন্ন করে কাগজ পত্র খুঁজতে লাগলাম।কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ আমার চোখে পড়ল


পর্ব-৬




কাগজ পত্র খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ আমার চোখে পড়ল একটা কাগজের কপি।কাগজের কপিটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।কাগজের কপিটা ছিল তৃনার সাথে রাজিবের ডিভোর্সের। আর সেটাতে দুজনের স্বাক্ষর ও দেওয়া হয়ে গিয়েছে।তার মানে রাজিব তৃনাকে ছাড়তে চাচ্ছে কিন্তু কেন?আমি এর কোন মানেই বুঝতে পারছিলাম না।রহস্যের একটা কড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম।রহস্যের গন্ধটা যেন আরও বেশি তীব্র হতে লাগল।সন্দেহের মাত্রাটাও বেড়ে যেতে লাগল।


তাই আবার খুঁজতে শুরু করলাম।খুঁজতে খুৃৃঁজতে সারা ঘর খুঁজেও কিছু পাচ্ছিলাম না।কোনভাবেই মাথায় আসছে না যে রাজিব কেন তৃনাকে ডিভোর্স দিয়েছে।কারন তৃনার প্রতি রাজিবের আগ্রহটা প্রথম থেকেই বেশি ছিল। তাহলে তৃনার কাছ থেকেও স্বাক্ষর নিয়ে ডিভোর্সটা কেন কার্যকর করল তার মানে মোটেও বুঝতে পারছিলাম না।তাহলে কি তৃনার সাথে রাজিবের কোন কিছু ছিল যা আমার চোখের আড়াল হয়ে রয়েছে।কোন দিক দিয়েই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না।রাজিব যদি তৃনাকে ডিভোর্সেই দিবে তাহলে এতদিন কিসের নাটক করল।ডাক্তার কোমল বলল আমার লাইগেজশন করানো হয়েছে।ধরে নিলাম রাজিব তৃনাকে বাচ্চার জন্য বিয়ে করেছে। রাজিবের বাচ্চার শখ এজন্য।আর আমাকে কষ্ট দিতে চাই না তাই হয়ত তৃনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে রাজিব আমার মাতৃত্ব কেন নষ্ট করল।কোনভাবেই কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে সবকিছু যেন আমার ভাবনার আড়ালে রয়ে গেল।হিসাবের খাতাটা বরাবারেই শূন্য। অংক কষলেও অংকের মানটা ভুলেই আসছে।


হুট করে তৃনার চেঁচামেঁচিতে চমকে গিয়ে কাগজটা নীচে পড়ে গেল।খেয়াল করলাম তৃনা বরমশাই বরমশাই বলে চেঁচাচ্ছে।তার মানে রাজিব চলে এসেছে।তারাহুরা করে কাগজটা যে জায়গায় ছিল সে জায়গায় রেখে রুমে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।কারন রহস্য পুরোপুরি ভেদ না করো জিজ্ঞেস করাটা বোকামি।রাজিবের উপর নজরদারি চালাতে হবে।তা না হলে কোন ভাবেই রহস্য বের করা যাবো না।


রাজিবকে দেখে তৃনা ঝাপটে ধরেছিল হয়ত।রাজিব বিরক্ত গলায় তৃনাকে বলতে লাগল


-আরে তৃনা ছাড়।মোটেও ভালো লাগছে না এসব।আমাকে ছাড় তুমি।রাগের মাত্রা বাড়িও না।


তৃনা তো মানসিক রোগী ওকে যেটা না করা হয় সেটা আরও বেশি করে। রাজিব যতই তৃনাকে না করছে।ততই তৃনা রাজিবকে ঝাপটে ধরেই রোখছে।খেয়াল করলাম রাজিবের বিরক্তটা যেন আরও বেড়ে যেতে লাগল।এত বিরক্ত মাখা মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে।তবুও ঐ রুমে যাচ্ছি না।আর ইচ্ছা করেই তৃনাকে কিছু বলছি না।সব শুনেও না শুনার ভাব ধরে বসে রইলাম।এমনিতেও রাজিবের প্রতি এখন কোন ভালোবাসা কাজ করছে না।ওর যা ইচ্ছা করুক তাতে আমার কি।আমার তো তাতে কিছু যায় আসে না।কিন্তু কোনভাবেই আমি তৃনাকে ডিভোর্স এবং তৃনার প্রতি এত বিরক্তের কারন বুঝতে পারলাম না।আইনত ধরতে গেলে এখন তৃনা রাজিবের স্ত্রী ও না।কিন্তু রাজিব এটা কেন করল।আর ডাক্তার কোমল যে কথাটা বলল সেটা কি সত্যি নাকি মিথ্যা সেটাও বুঝতে পারছিলাম না।


একবার মনে হচ্ছে রাজিবকে অবিশ্বাস করে ভুল করছি আরেকবার মনে হচ্ছে রাজিবকে বিশ্বাস করে ভুল করছি।কি যে করব বুঝতে পারছি না।সত্যি বলতে বিশ্বাস হল কাচের চুড়ির মত যত্ন করে রাখলে সেটা অটুট থাকে আর একটু অযত্নে তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।আমার অবস্থাটা ঠিক ঐরকম একবার মনে হচ্ছে বিশ্বাস করি রাজিবকে।রাজিব যা করছে হয়ত আমার ভালোর জন্য।আরেকবার মনে হচ্ছে রাজিব যদি সত্যিই আমার মতৃত্ব নষ্ট করে তাহলে রাজিব আমার সাথে সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছে।এসবেই মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল।


হঠাৎ করে একটা চড়ের আওয়াজ পেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসলাম।মনে হল যার গালেই চড়টা পড়েছে বেশ জোরেই পরেছে।তৃনা আবার রাজিবকে চড় দিয়ে বসল না তো?দৌঁড়ে তৃনার রুমে গেলাম কাহিনী জানার জন্য।গিয়ে দেখলাম রাজিব তৃনার গালে অনেক জোরে চড় দিয়েছে।আর তৃনার গালে আঙ্গুলের ছাপ বসে আছে।তৃনা ভয়ে বিছানার একপাশে জড়সড় হয়ে আছে।তৃনার অবস্থা দেখে রাজিবের প্রতি আমার রাগটা বেশ গাঢ় হল।কারন এমনিতেই তৃনা অসুস্থ।তার মধ্যে রাজিব এভাবে তৃনাকে আঘাত না করলেও পারত।আর তৃনা তো স্বাভাবিক কোন মেয়ে না।রাগে কর্কশ গলায় রাজিবকে বললাম


-এ মানসিক বিকারগ্রস্ত মেয়েটাকে তোমার চড় দিতে বিবেকে বাধঁল না।তার উপর ওর পেটে সন্তান আছে।কি করে এমন করতে পারলে তুমি।


রাজিব বেশ বিরক্ত হয়েই বলল


-তোমাদের দুই বোনের চক্করে পরে আমার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।দয়াকরে আমাকে মুক্তি দাও।আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব।এজন্য বাসায় আসতে মন চায় না।বাসায় আসলেই ঝামেলা বাঁধে।আর পারছি না।ক্ষমা কর আমায়


রাজিবের এখনের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে রাজিব নির্দোষ এ দুই বিয়ের চক্করে পরে হয়ত এমনটা করছে।হয়ত আমিও রাজিবের সাথে একটু বেশিই করে ফেলেছি।কিন্তু ডাক্তার কোমল কি তাহলে মিথ্যা বলল।আবার প্রশ্ন মনে আসতে লাগল।প্রশ্নের উপর প্রশ্ন মনটাকে আচ্ছন্ন করো দিচ্ছে।উত্তর পাচ্ছিলাম না।কালকে একবার অন্য ডাক্তার দেখালে মন্দ হয় না।বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।হ্যা এটাই করা উচিত।কারন আমি কাকে রেখে কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারছি না।লাগেজশনের ব্যাপারটা যদি মিথ্যা হয় তাহলে রাজিব তৃনাকে আমার সুখের জন্য ডিভোর্স দিয়েছে হয়ত।কারন রাজিব হয়ত বুঝতে পারে নি দুই বিয়ে করলে এমন ঝামেলায় পড়তে হবে।তাই হয়ত এমন করেছে।নাহ এত ইমোশনাল হলে চলবে না।কারন ডাক্তার কোমল কেন আমাকে মিথ্যা বলবে।উনার তো মিথ্যা বলে কোন লাভ নেই।হয়ত এর পিছনে বড় কোন রহস্য আছে।আপাতত চুপ করে থাকায় শ্রেয়।


রাজিব যা পারল বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।আর তৃনা ভয়ে কুকড়ে গেল।তার পাশে যেতেই খেয়াল করলাম চড়ের দাগটা ফর্সা গালে বেশ গাঢ় হয়ে হয়ে আছে।গালের দাগটায় হাত দিতেই তৃনা চিৎকার করে উঠল।ইশ ব্যাথা পেয়েছে অনেক।মলম এনে তৃনার গালে লাগিয়ে দিলাম।তৃনা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে আর বলে যাচ্ছে বরমশাই পঁচা।বরমাশাই এর সাথে কোন কথা বলব না বরমশাই আমাকে কষ্ট দেয়।আমি তৃনাকে বললাম


-তুমি তোমার বরমশাইকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে কেন?ছাড়তে বলেছে ছাড় নি কেন।


তৃনা কাঁদতে কাঁদতে বলল


-আমি তো বরমশাই এর সাথে খেলতে চেয়েছিলাম।বরমশাই খেলতে চাচ্ছিল না।তাই বরমশাইকে যেতে দিচ্ছিলাম না।তাই বরমশাই আমাকে এভাবে মেরেছে।আমি আর বরমশাই এর সাথে কথা বলব না।বলে তৃনা কাঁদতে লাগল।


আমি তৃনাকে রুমে রেখে আমার রুমে ঢুকার সময় খেয়াল করলাম।রাজিব তৃনার সাথে ডিভোর্স এর কাগজটা নিয়ে আলমিরার ড্রয়ারে রাখতেছে।আমার এবার মাথায় আসল আমি তো আলমিরার ড্রয়ার চেক করে নি।


বিয়ের পর থেকে এ ড্রয়ারটা রাজিব ব্যাবহার করত।অফিসের সব কাগজ পত্র এ ড্রয়ারে রাখত।আর চাবিটাও তার কাছে রাখত।এসব নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাতাম না।রাজিবের প্রতি আমার ছিল অগাধ বিশ্বাস।আর আজকে সে বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে।


ভেবে রাখলাম রাজিব বের হওয়ার সাথে সাথে ড্রয়ারটা ভাঙ্গব।রাজিবের বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম।খানিকক্ষণ পর রাজিব বসা থেকে বের হয়ে গেল।


আর এ সুযোগে আমি তালাটা লোক আনিয়ে ভাঙ্গালাম।ড্রয়ারটা খুলে যেসব কাগজ পত্র দেখলাম।তা দেখে আমার মাথা রিতীমত ঘুরাচ্ছে।আমার রাজিব এতটা নীচে নামতে পেরেছে এটা আমি ভাবতেই পারছি না।আমার রাজিব আমাকে এভাবে ঠকাতে পারল।হায়রে কাকে ভালোবেসেছিলাম আমি।এত বড় ভুল আমি কি করে করলাম।মাথায় খুব ব্যাথা হতে লাগল।


কারন প্রথম কাগজটা ছিল আমার টিউবাল লাইগেজশনের যে কথাটা আমাকে ডাক্তার কোমল বলেছিল।আর আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।রাজিব আমার মাতৃত্ব কেড়ে নিল।কিন্তু এতে তার কি লাভ হল। প্রথম কাগজটা দেখে বুঝতে পারি নি রাজিবের এতে লাভ কি?


কিন্তু দ্বিতীয় কাগজটা যখন দেখেছিলাম তখন ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগল।দ্বিতীয় কাগজটা ছিল তৃনার প্র্যাগনেন্সি এবং অ্যাবর্সনের ডেট এর কাগজ যেটা রাজিবের সাথে তৃনার বিয়ের আগেই করার কথা ছিল।তারিখটা তাই বলে।তার মানে রাজিবেই তৃনার সাথে নষ্টামি করেছে।এর পরে তৃনার সর্বনাশ করে বাচ্চা নষ্ট করার চেষ্টাও করেছিল।কিন্তু এর আগেই তৃনার পরিবার তৃনার ব্যাপারে সবটা জানতে পারে ।ইশ খালা মনি যদি জানত তৃনার সাথে রাজিব এমন করেছে তাহলে আজকে আমার মথাটা কতটা নীচু হত।খালামনি তাইত বলত তৃনাকে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত না কোথায় জানি চলে যেত।রাজিবেই এ কাজ টা করেছে তৃনাকে সহজ সরল পেয়ে।তারপর এ বিয়ের নাটক করে তৃনাকে দ্বিতীয় বারের মত ভোগ করেছে।রাজিবের সন্তানেই তৃনার পেটে বুঝতে বাকি রইল না।বিয়ের তিনমাস পরেই ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে আর সেটা আমাদের কাছে আড়াল করেছে।কত পাকা খেলোয়ারের মত খেলছে।ছিঃ।নিজের উপর ঘৃনা হচ্ছে যে আমি এমন মানুষের সাথে সম্পর্ক করেছি আর এমন মানুষকে বিয়ে করেছি এটা ভেবে।
তৃতীয় কাগজটা ছিল একটা কাবিনের কাগজ।হুম রাজিবের তৃতীয় বিয়ে বলব নাকি দ্বীতিয় বুঝতে পারছি না।কারন তৃনার আগেই রাজিব ঐ মেয়েকে বিয়ে করেছে।ইশ কতটা বোকা আমি রাজিব আমাকে তৃনার মধ্যে ব্যাস্ত রেখেছে যাতে করে আমি অন্য মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে না পারি।কতটা নীচু সে আর কতটা পাকা খেলোয়ার ও বটে।


চতুর্থ কাগজটা দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না আমার সাথে কেন এমন হয়েছে।আর আমার বাবা দুনিয়াতে নেই সেটাও বুঝতে পেরেছি।চতুর্থ কাগজটা ছিল আমার বাবা তার সমস্ত সম্পত্তি আমার স্বামীর নামে করে দিয়েছে সেটার দলিল।


পঞ্চম কাগজটা দেখে আমি আমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপার টা নিশ্চিত হলাম।কারন সেটা ছিল আমার বাবার ডেট সার্টিফিকেট।আজকে আমার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।এত ভালো নাটক যে রাজিব করতে পারে বুঝতেই পারি নি।আমার মাতৃত্বটা নষ্ট করে কি সুখ পেল।সামান্য সম্পত্তির জন্য এমন নাটক করতে পারল।ভালোবাসার কমতি তো কখনও তাকে দেয় নি।তার আর্থিক অবস্থা নিয়েও তো কখনও কিছু বলে নি।তাহলে এমন কেন করল আমার সাথে।আমি তো কোন দোষ করে নি।


আমার সাথে করেছে সেটা না হয় আমি ক্ষমা করে দিতাম।কিন্তু বাবার সাথে,তৃনার সাথে কেন এমন করল।তৃনা তো কিছুই বুঝে না এসবের।ওর সাথে এতটা নীচু কাজ করতে রাজিবের বিবেকে আটকাল না।আহারে আমার বাবাটা মরে গিয়েছে নাকি মার্ডার হয়েছে জানি না।তবে খারাপ কিছু হয়েছে যে তা বুঝতে পেরেছি।আজকে হাতে ঐরকম প্রমাণ নেই।কারন তৃনার সাথে রাজিবের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।


আর যে মেয়েটাকে সে তৃনার আগে বিয়ে করেছে।রাজিব চালাকি করে আগেই তৃনার বিয়ের অণুমতির জায়গায় ঐ মেয়ের বিয়ের অণুমতির জন্য কৌশলে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে।আদালতে গিয়ে কথা বললে সব প্রমাণ আমার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলবে।আজকে আমি কাকে বিচার দিব আর বলব আমাকে ন্যায় বিচার দিন।কষ্টে তো কলিজা ফেটে যাচ্ছে।


বাবার মৃত্যুর জন্য মামলা করব তার ও উপায় নেই।কারন ডেড সার্টিফিকেট গার্ডিয়ানের স্বাক্ষরটা আমার দেওয়া।হয়ত এখন মামলা করলে রাজিব সরাসরি বলবে যে সম্পত্তির জন্য আমি মিথ্যাচার করছি।


সবকিছুর পর যখন আমি ষষ্ঠ কাগজটা দেখলাম তখন ভিতরটা পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেল।ষষ্ঠ কাগজটা ছিল আমার আর রাজিবের ডিভোর্স পেপার।আর সেটাতে স্ব ইচ্ছায় রাজিবকে আমি ডিভোর্স দিয়েছি এমন লিখা।আর সে ডিভোর্স এর তারিখ অণুযায়ী কিছুদিন আগে ডিভোর্সের তিনমাস পার হয়ে গিয়েছে এবং ডিভোর্স কার্যকর হয়ে গিয়েছে।সব খেলা আমার সামনে।আমার সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগে কত স্বাক্ষর নিয়েছে হিসাব নেই।আর সে বিশ্বাসটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়াল। বুঝতে আর বাকি রইল না এ বাড়িতে আমি আর তৃনা বেশিদিন থাকতে পারব না।


তাই একবুক হতাশা নিয়ে তৃনার কাগজপত্র গুলো হাতে নিয়ে ডাক্তার কোমলের কাছে গেলাম।কাগজপত্র দেখে ডাক্তার কোমল যা বলল তা শুনার মত ধৈর্য আমার ছিল না।নিমিষেই অস্থিরতা কাজ করতে লাগল।নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।নিজেকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করলাম।মনের জোর বাড়িয়ে কিছুক্ষণ নিস্তব হয়ে বসে রইলাম।তারপর কাগজগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলাম।তৃনার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম।কত অবিচারটাই তার সাথে হল আর সেটার কোন সাক্ষী প্রমাণ নেই আজকে।


ডাক্তার কোমল বলল


-মিসেস সাদিয়া।কগজপত্রগুলো এটাই বলতেছে যে তৃনার বাচ্চা হওয়া নিয়ে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।মা বাচ্চার জীবনের হুমকি আসতে পারে।প্রথম থেকে কোন ট্রিটমেন্ট সঠিকভাবে করা হয় নি তাই এ অবস্থা।এখন সবকিছু সঠিকভাবে চাইলেও করা সম্ভব না।তাই আল্লাহ আল্লাহ করুন।


বসায় বসে চুপটি মেরে রইলাম।রাজিবের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।আজকে আসলে তাকে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করব।


অপেক্ষা করতে করতে হুট করে খেয়াল করলাম রাজিব এসেছে।রাজিবকে দেখে আমার রাগটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।রাজিবের সামনে কাগজগুলো টুকরো টুকরো করে ছিড়ে একটা চড় দিয়ে বললাম


-এত জঘন্য অভিনয় করতে বিবেকে বাঁধল না।কি দোষ করেছিলাম আমি। কেন আমার মাতৃত্ব নষ্ট করলে তুমি?আমার বুকের কলিজটাকে কেন পৃথিবীতে আসতে দিলে না বল।কেন এত নীচু কাজ করলে।আমি মামলা করব তোমার নামে ডাক্তার কোমল এর স্বাক্ষী দিবে।


রাজিব আমার গালে একটা চড় দিয়ে বলল


-মামলা করেও লাভ হবে না কারন সব প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে কাজ করবে।ছোটবেলা থেকে মামা মামীর কাছে বড় হয়েছি।মামাত বোন লিরাকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম।কিন্তু বাবা, মা আর অর্থ সম্পদ ছিল না বলে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।অনার্সে উঠে তোমার সাথে পরিচয়।রাজকন্যা সাথে রাজত্ব কে ছাড়ে এ সুযোগ।আমিও ছাড়ি নি।সুযোগ কাজে লাগিয়েছি।লিরাকে বলে এত বড় নাটক করেছি।আর লিরাকে আমি বিয়েও করেছি।আইনত এখন তুমি আমার স্ত্রী না।আর এই যে কাগজ গুলো টুকরো করলে এগুলো কপি করা মূল কাগজতো আমার হাতে।যদিও তোমার হাতে তৃনার সাথে আগে করা কুকর্মের একটা কাগজের প্রমাণ ছিল তোমার বকামির জন্য সেটাও হারালে।দয়াকরে এ বাসা থেকে বের হয়ে যাও।সাথে তোমার পাগল বোনটাকে নিয়ে যাও।আমি তোমার স্বামী না আর তুমি আমার স্ত্রী না।আর খারাপ করার আগে বের হয়ে যাও।


রাজিবের কথা শুনে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।তবে মনটা শক্ত করে তৃনাকে নিয়ে বের হয়ে চলে আসলাম।খালার বাসায় উঠলাম খালাকে সবটা বললাম।খালাও কি করবে বুঝতে পারছিল না।কারন খালাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না।আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিলাম।আমার কাছে সম্বল মাত্র ২ লাখ টাকা ছিল যেটা আমি আমার একাউন্টে জমিয়ে রেখেছিলাম।সেখান থেকে আমি তৃনার খরচ চালাতাম।একমাস পর জানতে পারলাম রাজিব বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গিয়েছে।হুম হয়ত অনেক সুখে আছে।আল্লাহ যারা ঠকায় তাদের সুখী রাখে আর আমি ঠকলাম আমার জন্য কষ্টটাই বরাদ্দ হল।এমনটাই মনে হত সবসময়।আল্লাহর কাছে বসে বসে কান্না করতাম।


কিছুদিন পর তৃনার বাচ্চা হল আর তৃনা মারা গেল।মারা যাওয়ার সময়ও তৃনা বলেছিল বরমশাই কোথায় আমার।শুনে কলিজাটা ফেটে গিয়েছিল।মেয়েটার সাথে কত বড় অন্যায় হল আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।(মাঝখান দিয়ে একটা মামলা করেছিলাম।কিন্তু রাজিব টাকা দিয়ে সেটা চাপা দিয়ে দিয়েছিল।এরপর আর মামলা করার মত টাকা হয় নি।আর রাজিবও কোথায় গিয়েছিল তাও জানতাম না।)


বাচ্চাটা কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলাম।পৃথিবীতে এসেই মাকে হারাল আর বাবা বেঁচে থেকেও মৃত।শুরু হল আমার সংগ্রাম করে বাঁচার লড়াই।


তারপর একদিন খেয়াল করলাম…



পর্ব -৭




তারপর একদিন ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার একাউন্টে মাত্র ৩০ হাজার টাকা রয়েছে।রায়ানার জন্মের সময় তৃনার পিছনে প্রায় ১ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।তবুও তৃনাকে বাঁচাতে পারি নি।ওহ বলায় হলো না তৃনার একটা মেয়ে বাচ্চা হয়েছে।মেয়েটার নাম তৃনায় রেখে গিয়েছিল। তৃনা রায়ানার জন্মের আগে থেকেই বলত


-জান আপি আমার আর বরমশাইয়ের একটা মেয়ে হবে।মেয়ের নাম দিব রায়ানা নামটা সুন্দর না??


আমি তৃনার কথা শুনে শুধু ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম।মেয়েটার মনে কোন পাপ নেই।আর এ মেয়েটার সাথে এমন হয়েছে।তৃনার বাবা মরে যাওয়ার পরেই তৃনা ধাক্কা সামলাতে পারে নি।এর পরই পাগল হয়ে গিয়েছিল।আজকে হয়ত পাগল তাই ঐরকম কিছু টের পাচ্ছে না।সারাদিন শুধু বরমশাই বরমশাই বলে বুলি আউরাচ্ছে।কিন্তু ওর বরমশাই যে ওর সাথে কি করেছে সেটা জানলে হয়ত ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিত।নিমিষেই চোখে জল চলে আসল।জীবনে কি পাপ করেছিলাম তার ফল এভাবে পাচ্ছি জানি না।কষ্টে বুকটা ফেটে গেল।কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারতাম না।চোখের জল এমনিতে পড়তে থাকত।তৃনা ধাক্কা দিয়ে বলল


-কি গো আপু নামটা বুঝি পছন্দ হয়নি তোমার?


আমি তখন নীরব যন্ত্রণাটাকে আড়াল করে মুচকি হেসে বলতাম


-খুব সুন্দর নাম।


তৃনা তখন উড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে হাসত আর লজ্জা পেত।এর পর তৃনার বাচ্চা হওয়ার পর এ নামটাই রাখি।
এখন ও যেন চোখে এগুলো ভেসে উঠছে।ওপারে আমার বোনটা ভালো থাকুক।


কিন্তু এদিকে ব্যাংকে অল্প কয়টা টাকা দেখে বেশ হতাশ হলাম।অপরদিকে তৃনার ভাই আর ভাই এর বউ এর মধ্যে আমাকে নিয়ে বেশ অশান্তি চলছে।অশান্তির আগুনে খালাও পুড়ছে।খালা আমাকে বুঝতে দেয় নি এতদিন।তবে সেদিন স্পষ্ট কয়েকটা বিষয় আমার সামনে চলে আসে।তৃনার ভাই সাইদ খালাকে বলল


-তোমার মেয়ের পাপ আর ঐ সাদিয়া বাড়ি থেকে বিদায় হবে কবে।কাজ না করে বসে বসে খাচ্ছে।মানুষের বাসায় কাজ করলেও রক্ষা পাই আমরা।একা রোজগার করে নিজেই চলতে পারছি না তার উপর এসব পাপের বোঝা চালাতে হচ্ছে।


খালা সাইদকে কথা আটকে দিয়ে বলল


-আস্তে বল।সাদিয়া শুনতে পারবে।


সাইদ গলাটা আরও উঁচু করে বলল


-আমি কি কোন ভুল বলেছি নাকি, যে আস্তে আস্তে বলতে হবে।আর কত এসব পাপের বোঝার দায়িত্ব নিব ওদের বের হয়ে যেতে বল।আমার পক্ষে আর কাউকে বসিয়ে বসিয়ে গিলানো সম্ভব না।


সাইদের কথাগুলো শুনে ভিতরে বেশ আঘাত পেলাম।কারন আমার যখন টাকা ছিল তখন এরাই আমার কাছে কিছু হলে ছুটে আসত।কত কথায় না বলত।বোন বোন করে পাগল করে রাখত।আর আজকে এমন কথাগুলো আমাকে বাস্তবতা চিনিয়ে দিচ্ছে।বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়।সুসময়ে মানুষ চিনা খুব কঠিন।


ভেবেছিলাম বাসাটা ছেড়ে যাব কিন্তু এত অল্প টাকায় বাসা ছেড়ে গিয়ে কয়দিন খাব।তাই চিন্তা করলাম একটা চাকুরী জোগাড় করব।আমার যা যোগ্যতা আছে তা দিয়ে একটা চাকুরী তো পাবই।


শুরু হলো আমার নতুন সংগ্রাম।হায়রে এ অভাবের দেশে চাকুরী পাওয়াও বেশ দায়।বুঝে গিয়েছিলাম যোগ্যতা অণুযায়ী টাকা ছাড়া কোন চাকুরী পাব না।তাই নিজেকে আরও শক্ত করে নিজের যোগ্যতা থেকে নীচে গিয়ে চাকুরী খুঁজতে লাগলাম।অবশেষে মাত্র ১২ হাজার বেতনের একটা রিসিপশনের চাকুরী পেলাম।কোনরকমে চকাুরীটাতে ঢুকে গেলাম।কারন এখন নিজের পেট চালাতে হলেও চাকুরীর দরকার।


খালাকে গিয়ে বললাম


-খালা একটা চাকুরী পেয়েছি।তাই আমি চিন্তা করেছি এ বাসা থেকে চলে যাব।অন্য জায়গায় বাসা নিব।আর কত এ বসায় থাকব বল।অনেক তো করেছ তোমরা।এবার যেহুত রোজগারের ব্যাবস্থা হয়েছে তাই চাচ্ছিলাম বাসা ছেড়ে অন্য বাসায় যেতে আর আমি একটা বাসা ঠিক করেও এসেছি।


পাশে থাকা সাইদের বউ বিড়বিড় করে বলতে লাগল।আপদ এবার বিদায় হবে মনে হচ্ছে যাক বাঁচা গেল।


আমি সাইদের বউ এর কথা না শুনার ভান ধরে খালাকে বললাম


-খালা যা বলতেছিলাম। অন্য জায়গায় বাসা নিয়েছি।কিন্তু রায়ানাকে। একা রেখে তো চাকুরী করা সম্ভব না।আর যে চাকুরীটা নিয়েছি সেটাতে রায়ানাকে নিয়েও যাওয়া যাবে না।চাকুরীর বেতন ও স্বল্প।অল্পদামে একটা বাসা নিয়ে ডাল ভাত দুই বেলা কষ্ট করে জুটবে।তুমি আমার সাথে গেলে ভালো হত।


খালা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল


-কেন যাব নারে।আমার কলিজাটা ফেটে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।কোথায় থাকার কথা ছিল আর কোথায় আছিস তুই।আমাকে নিয়ে চল।যেখানে নিয়ে যাবি থাকব।


পাশ থেকে সাইদের বউ আবার খুঁচা দিয়ে বলল


আদিক্ষিতা দেখে আর বাঁচি না।মা যান সাদিয়ার সাথে যান যখন পেটে খাবার পড়বে না তখন বুঝবেন।আর এমনিতেও সাদিয়ার মত আপদ বিদায় হচ্ছে এতে অনেক খুশি।সাথে আপনার মত আপদ নিয়ে গেলে তো আরও খুশি।


খালা রেগে গিয়ে সাইদের বউকে কিছু বলতে নিল।আমি খালার মুখটা আটকে দিয়ে বললাম


-সবসময় প্রতিবাদ করতে নেই খালা। আমি একটা বাসা ঠিক করে রেখেছি কালকে সব মাল নিয়ে বাসায় উঠব।এ খাট টা আর টেবিলটা নিলেই হবে।রায়ানার কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখ।আর তোমার কাপড় চোপড়ও।


রায়ানার বয়স তিন মাস চলে।মেয়েটা টুকিটাকি হাসে।একটা তিনমাসের বাচ্চার অনেক কাপড়চোপড় থাকলেও আমার মেয়ের মাত্র ৭ সেট কাপড়।রায়ানাকে দেখে মাঝে মাঝে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি। ভাবি কোথায় রাজকন্যা হয়ে জন্ম নিয়ে রাজত্ব করার কথা ছিল।আর আজকে দাসীর মত বড় হচ্ছে।


রাতে খালা রায়ানার কাপড়চোপড় এবং খালার আর আমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখল।সকালে উঠে খাট আর টেবিলটা নিতে চাইলাম।সাইদ বলে বসল


-এখান থেকে কিছুই নেওয়া যাবে না।এগুলো আমরা সিকি দিয়ে কিনি নাই।খালি হাতে বিদায় হও।টাকা গাছে ধরে নাকি।টাকা দিয়ে খাট কিনে নাও।


আমি আর আনার সাহস করলাম না।কারন আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল।বলার মত ভাষাও ছিল না কিছু।শুধু রায়ানার দুধ ঘরম করার পাতিল টা নিয়ে ব্যাগে রাখলাম।কতক্ষণ পর সাইদের বউ এসে পাতিলটা বের করে বলল


- এ পাতিল কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?


আমি শান্ত গলায় বললাম


-ভাবী রায়ানার দুধ গরম করি এটাতে।রায়ানাকে দুধ গরম করে খাওয়াতে হবে।আর না হয় মেয়েটা না খেয়ে থাকবে।


এ বলে ভাবীর হাত থেকে পাতিলটা নিতে চাইলাম।ভাবী আমার হাতটা সরিয়ে বলল


-আমি অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে এ পাতিল কিনেছি।বাজারে পাতিলের অভাব নেই ঐখান থেকে কিনে নাও।আমার পাতিল কাউকে দিব না।বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে পাতিল কিনেছি।


খালামনি বলে উঠল


-পাতিলটা আর কত দাম দিয়ে দাও।মেয়েটার খাবারের কষ্ট হবে না হয়।আজকের দিনটার জন্য না হয় দাও।পরে পাতিল কিনলে দিয়ে যাবে নে।কারন মেয়েটাকে গিয়ে তো খাওয়াতে হবে।না হয়, না খেয়ে মরে যাবে মেয়েটা।


ভাবি বিকট গলায় জবাব দিল


-পাপের ফল মরে গেল আরও ভালো।পাতিল দিয়ে আরও পাপ করব নাকি।আমার পাতিল এ পাপটার জন্য দিব না।আমার পাতিল আমি হালাল টাকাই কিনেছি।কোন পাপের ফসলের জন্য না।আমার পাতিল কাউকে দিব না।যেই না মেয়ে তার আবার বাঁচা মরা।মরে গেলে তো বেঁচে যাবেন আরও।এরকম পাপ রেখে কি লাভ তার উপর বাপের পরিচয় নেই।


ভাবীর কথাগুলো শুনে গা টা জ্বলে যাচ্ছিল।ভাবীকে কিছু না বলে পারছিলাম না।তাই ভাবীকে বললাম


-যা বলার আমাকে বলুন বাচ্চাটাকে কেন টানছেন।বাচ্চাটা তো কোন দোষ করে নি।একটা পাতিল তো আর কিছু না।দিলে কি এমন হত।দিবেন না ভালো কথা তবে মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে কথা কেন বলছেন।ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।ভদ্রতা কি কখনও শিখেন নি।অশিক্ষিতদের মত আচরণ কেন করছেন।কোন কিছু না দিতে চাইলে সেটা না করে দিবেন।আর ভালোভাবে না করা যায়।সামান্য বাচ্চা নিয়ে এত কাঁদা ছুরাছুরির কি আছে?


ভাবী তিরস্কারের সুরে জবাব দিল


-তোর মত ডিভোর্সীর মুখে আমার ভদ্রতা শিখতে হবে।অলক্ষী মেয়ে।ভাগ্য ভালো তোর মত শিক্ষিত হয় নি।না হয় আমার ও ডিভোর্স হত।অপয়া মেয়ে।স্বামী কি আর এমনে এমনে ছেড়ে গিয়েছে।দোষ তো তোর ও ছিল।আবার আমাকে ভদ্রতার জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে।বেলাজ মাইয়া। এজন্যই তোর জামাই তোকে ছাড়ছে।


ভাবীর তুই তোকারি ভাষা শুনে আর টিকতে পারলাম না।পাতিলটা রেখে চলে গেলাম নতুন বাসায়।কান্না এসেও যেন বুকের মধ্যে থেমে গেল।নতুন বসায় কিছু নেই।হাতে তেমন টাকাও নেই দৌঁড়ে ব্যাংকে গেলাম টকা উঠাতে।বিশাল বড় লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম।খালা ফোন দিয়ে বলল


-সাদিয়া রায়ানা ক্ষুধায় কাঁদতেছে।পাতিল নাই কোন। কিসে দুধ গরম করব বল।কি করব এখন।মেয়েটা যে চিৎকার করতেছে।


আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তখন।আমার মেয়েটা এ বয়সে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করতেছে।হায়রে বাস্তবতা এত নির্মম কেন। কেন আল্লাহ আমায় এত দুঃখ দিতেছে।ফোনটা কেটে দিলাম।চোখ দিয়ে পানি টপ টপ করে পড়তে লাগল।কিছুক্ষণ পর কল দিয়া খালাকে বললাম


-রায়ানা কি এখনও কাঁদতেছে।


খালা বলল


- কান্না থামাতে পারছি না কি করব বল।ক্ষুধার জ্বালা কি এটুকু বাচ্চা সহ্য করতে পারে নাকি।কি করব আমি।কাউকে চিনি না কার কাছে পাতিল চাইব বল।


আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম


-ট্যাপের পানি নিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়েই দুধ বানিয়ে খাওয়াও।আর কিছু করার নাই।


বলে ফোনটা কেটে দিলাম।সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না আর।চিল্লায়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল তবুও কাঁদতে পারছিলাম।কেন এমন হল আমার সাথে কি ক্ষতি করেছিলাম।কেন এটুকু বাচ্চা এ বয়সে এত কষ্ট পাচ্ছে।এসব ভাবতে লাগলাম।আর লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম


অবশেষে বিশাল বড় লাইন পার হয়ে ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা তুলাম।সে টাকা দিয়ে কিছু পাতিল আর তুশক কিনে নিয়ে গেলাম।৪৭০০ টাকা খরচ করেছি মোট। বাকি টকাটা রেখে দিলাম।কখনও কোন বিপদ হলে কাজে লাগবে।সবকিছু নিয়ে ঘরে ঢুকে যেন কলিজাটা আরও ফেটে গেল।কারন আমার মেয়েটা খালি মেঝেতে আমার উড়নার উপর শুয়ে আছে।এ বয়সের মেয়েরা কত নরম বিছানায় শুয়ে থাকে আর আমার মেয়েটা একটা শক্ত মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।খালা আমাকে দেখে বলল


-পাতিল এনেছিস।


খালাকে মাথা নাড়িয়ে বললাম এনেছি।আর বললাম


-রায়ানা কখন ঘুমিয়েছ।


-একটু আগে।


খালাকে বললাম


-রায়ানাকে একটু তুল।তুশক এনেছি মেঝেতে বিছিয়ে দিব।আর এ বাজার গুলো দিয়ে রান্না কর।যা পেরেছি অল্প দামে এনেছি।


খেয়াল করলাম খালার চোখ গুলো শুধু ছল ছল করছে কিন্তু কথা বলতে পারছে না।আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রান্না ঘরে চলে গেল।আর আমি রায়ানাকে এক পাশে শুইয়ে দিয়ে তুশকটা বিছালাম।চাদরটা বিছালাম।বালিশ দুইটা নিয়ে রায়ানাকে শুইয়ে দিলাম।রায়ানা ঘুম থেকে উঠেই আমাকে দেখে হাসি দিল।মেয়েটা এত মায়া করে হাসে।তার দিকে তাকালে যেন মনে হয় আমার দুনিয়া একদিকে আর ওর হাসিটা একদিনে।খুব খুশি হয়েছি আমার মেয়েটা দেখতে তৃনার মত হয়েছে।কারন রাজিবের মত হতে দেখলে কষ্টটা আরও বেড়ে যেত।কি ভাগ্য মেয়েটার, জন্মের পর থেকে বুকের দুধ পায় নি খেতে।আর আজকে তো ঠান্ডা পানি দিয়ে জীবাণু মিশ্রিত দুধ খেল।হায়রে জীবন।


এর মধ্যে খলা কয়েকটা রান্না করে আনল।তা দিয়ে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম।কারন সকাল ৯ টায় অফিস।পরদিন সকালে উঠে সবকাজ শেষ করে অফিসে গেলাম।অফিসে সবকিছু দেখে অবাক হলাম।প্রথমদিন নতুন ম্যানেজার আমাকে দেখে বেশ ঝাড়ি দিয়ে বলল



পর্ব-৮




ম্যানেজার আমাকে দেখে বেশ ঝারি দিয়ে বলল


-এভাবে মলিন হয়ে এসেছ কেন?বাকিদের দেখে একটু শিখ।এ কাজে নিজেকে পরিপাটি রাখা জরুরী।এ ভাবে মলিন হয়ে আসলে চলবে না।


আমি উনার কথার জবাব কি দিব বুঝতে পারছিলাম না।চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।উনি আমার এরকম নীরবতা দেখে পাশে থাকা মেয়েটাকে বলল


-এই পারভীন ওর ড্রেসটা ওকে দিয়ে দাও।শাড়িটা নিয়ে ওকে রেডি হয়ে আসতে বল।


পাশে থাকা মেয়েটা ম্যানেজারকে বলল


-জ্বি স্যার দিচ্ছি।


ম্যানেজার সেখান থেকে প্রস্থান নিল।পারভীন নামের মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল এ শাড়িটা এখানের সব রিসিপশনরা পড়ে তুমিও পড়ে নাও।এটা রিসিপশনদের জন্য ড্রেসকোড পড়ে নাও।আমি মেয়েটার কাছ থেকে শাড়িটা নিয়ে বললাম


-একা শাড়ি তো পড়তে পারব না।তুমি আমার সাথে আসলে একটু ভালো হত।


মেয়েটা একটু হেসে বলল


-চল আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।চিন্তা করার কিছু নেই।আমিই শাড়ি পড়িয়ে দিব।আমি কিন্তু ভালো শাড়ি পড়াতে পারি।


বলেই হুহু করে একটু হাসল।অতঃপর মেয়েটাকে নিয়ে একটা রুমে গেলাম চেন্জ করার জন্য।কিন্তু বিপত্তি ঘটল আমার কোন ব্লাউজ পেটিকোড নেই।শাড়িটা ঠিকেই কোম্পানি থেকে দিয়েছে কিন্তুু ব্লাউজ পেডিকোড নিজের আনতে হবে সেটা বলে দিয়েছিল।এত প্রেসারের মধ্যে সব ভুলে বসে আছি।ব্লাউজ ছাড়া কিভাবে শাড়ি পড়ব এটা ভেবেই পাচ্ছিলাম না।পাভীনের দিকে নিরীহ চোখে তাকিয়ে বললাম


-আমি তো কোন ব্লাউজ পেটিকোড আনি নি।আমি কিভাবে শাড়িটা পড়ব।


পারভীন হাসতে হাসতে বলল


-কি বেক্কেলের মত কাজ কর তুমি।এখন থেকে ব্লাউজ পেটিকোড দুইটা সাথে রাখবা।দাঁড়াও আমার একটা আছে আমি তোমাকে দিচ্ছি।কালকে না হয় ফেরত দিও।আর শুন আমার ব্লাউজ তোমার অনেক ঢিলা হবে।একটু পিন দিয়ে আটকে কোন রকমে পড়ে নিও।


এ বিপদে অপরিচিত একটা মেয়ে এটুকু করছে এটাই তো অনেক।কেউ এই তো এভাবে এগিয়ে আসে নি কখনও।আমি হাসি মাখা মুখে মেয়েটাকে বললাম


-ঢিলা হলেও সমস্যা হবে না।তুমি আমাকে দাও।আমি ঠিক করে নিব। এ বিপদে এটুকু সাহায্য করছ এটাই তো অনেক।


মেয়েটা হাসতে হাসতে তার ব্যাগ থেকে ব্লাউজ আর পেটিকোড বের করে আমার হাতে দিল।ব্লাউজটা পড়ে দেখলাম আমার শরীরে বেশ ঢিলা হচ্ছে।হবেই বা না কেন?ঠিক মত খাবার খায় নি, চিন্তার শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছি।তাই ব্লাউজটাকে কোন রকমে পিন দিয়ে আটকিয়ে শাড়িটা পড়া শুরু করলাম।মেয়েটাকে বললাম তুমি আমার আঁচল আর কুচি ঠিক করে দাও।মেয়েটা আমার আঁচল আর কুচি ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করল


-তোমার নাম কি?
-সাদিয়া।
-পরিবারে কে কে আছে?
-খালা মনি আর মেয়ে।
-মা বাবা নেই?


কান্না গলায় বললাম


-অনেক আগেই মারা গিয়েছে।
-ইশ সরি আমি বুঝতে পারি নি।
-সমস্যা নেই।আমি কিছু মনে করি নি।
-তোমার স্বামী নেই?


এবার এক বিন্দু জল চোখের কোণে চলে আসল।কি উত্তর দিব মেয়েটাকে ভেবে পাচ্ছিলাম না।কি উত্তর দেওয়া ঠিক হবে তাও মাথায় আসছে না।চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম


-স্বামী মারা গিয়েছে ৬ মাস আগে।এখন পরিবারে আমার মেয়ে আছে শুধু।আমার মেয়েই আমার সব।


-আহারে আবারও কষ্ট দিলাম।কিছু মনে কর না।আমি তো জানতাম না।মাঝে মাঝে আমি এমন কাজ করে ফেলি।সরি। সত্যিই এখন খারাপ লাগছে খুব।


আমি হাসতে হাসতে বললাম


-কিছু মনে করে নি।কেন কিছু মনে করব।তুমি জান না তাই জানতে চেয়েছ।এতে মনে করার মত কিছু নেই।যেটা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।


ইতিমধ্যে আমার শাড়িটা পড়া শেষ হয়ে গেল।তাই শাড়িটা পড়ে বের হতে চাইলাম রুম থেকে।পারভীন আমার হাতটা টেনে বলল


-এভাবে নির্জীব চেহাড়ায় গেলে হবে?হালকা সেজে নাও।দাঁড়াও আমি সাজার জিনিস দিচ্ছি।এ বলে মেয়েটা ব্যাগ থেকে লিপস্টিক,ফেস পাউডার আর কাজল বের করে আমার হাতে দিল।আমি এগুলা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।একসময় আমি সবসময় সাজতাম।আমার চোখ থেকে কাজল আর ঠোঁট থেকে লিপস্টিক যেন নড়তই না।আর আজকে না সাজতে সাজতে কিভাবে সাজতে হয় সেটাও ভুলে গিয়েছি হয়ত।হাত থেকে মেক আপটা নিয়ে হালকা সেজে নিলাম। প্রায় ১ বছর পর হয়ত এভাবে সাজলাম।আয়নায় নিজেকে দেখে কেন জানি বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে।স্তব্দ হয়ে রইলাম।ঠাঁই আয়নার দিকে চেয়ে দাড়িঁয়েই রইলাম।পারভীন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল


-বাহ তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে।তোমার চেহাড়াটা কিন্তু বেশ মিষ্টি।


চুপ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম।কোন জাবাব দিলাম না।পারভীন আমাকে আরেকটা ধাক্কা দিয়ে বলল


-আমার সাথে চল এবার। দাঁড়িয়ে কি ভাবছ?


আমি পারভীনের ধাক্কা খেয়ে হুশে ফিরলাম।কি জানি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।ওকে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।কাজে মনযোগ দিলাম।আমি খুব সাবলীল ভাবে কাজ করতে লাগলাম।কথার কোন জড়তা কখনও ছিল না।তাই কাজটা করতে আমার বেশ কঠিন লাগে নি।প্রথম দিনেই আমার কথার বচনভঙ্গিতে সবাই খুশি।দুপুরের দিকে পারভীন ডেকে বলল


-ব্রেক দিয়েছে চল ক্যান্টিনে খেয়ে আসি কিছু।এখানের ক্যান্টিনের খাবার অনেক মজা। না খেলে বুঝবা না।চল যাই খেয়ে আসি।


আমি পারভীনকে বললাম


-আমার খেতে ইচ্ছা করছে না তুমি যাও। গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা আছে বাইরে খেলে সমস্যা হয়।তুমি খেয়ে আস।


-ওহ আচ্ছা ঠিক আছে.


এ বলে পারভীন চলে গেল।খেতে ইচ্ছা করছে না যে তা না।আমার কাছে এ সময় বাইরে খেয়ে টাকা নষ্ট করার মত টাকা নেই। পারভীন মেয়েটা সবে ইন্টার পাশ করেছে।পড়ালেখার পাশাপাশি শখের বশে জবটা করতেছে কিন্তু আমার তার সাথে পাল্লা দিলে চলবে না।আমাকে একটা টাকা ভাঙ্গতে গেলেও হিসাব করে ভাঙ্গতে হবে।তাই খিচ মেরে চুপ করে বসে রইলাম।খানিকক্ষণ পর ব্রেক শেষ হল।আবার কাজে মন দিলাম।বিকাল তখন ৫ টা।ক্ষুধায় মনে হচ্ছে পেট জ্বলে যাচ্ছে।হায়রে ক্ষুধার যন্ত্রণা যে কি ক্ষুধার্থ না হলে বুঝা যায় না।পেটে ব্যাথা শুরু করেছে ক্ষুধায়।এতটা খারাপ লাগছে বলে বুঝাতে পারব না।তবুও নিজেকে সামলে কাজ করতে লাগলাম।কাজ শেষ হল সন্ধ্যা ৭ টায়।পারভীনের সাথেই অফিস থেকে বের হলাম।


পারভীন বেশ মিষ্ট স্বভাবের একটা মেয়ে।জানতে পারলাম আমার বাসাটার পাশের গলিতেই ও থাকে।ও একটা রিকশা ভাড়া নিল।আমাকেও সাথে উঠতে বলল।কিন্তু আমি উঠলাম না।কারন আমি ভেবে দেখলাম রিকশার ভাড়া ২০ টাকা। মানবতার খাতিরে হলেও আমাকে ১০ টাকা শেয়ার করতে হবে।এখন আমার কাছে ১০ টাকায় অনেক কিছু।তাই কাজ আছে বলে না করে দিলাম।


আর হাঁটা শুরু করলাম।আধা ঘন্টা হাঁটার পর বাসায় পৌঁছালাম।দরজার পাশে যেতেই খালার মৃদু কন্ঠ শুনতে পেলাম।খালা রায়ানাকে বলছে আমার নানু মনি বড় হয়ে কি হবে?আর রায়ানা আআআআ...আআআআআ..করে যাচ্ছে।আর খালা অনর্গল কথা বলছে।আমার নানুমনি বড় হয়ে ডাক্তার হবে।নাকি একদম মায়ের মত সংগ্রামী হবে।আহা নানী নাতিনের কি মধুর কথাবার্তা।এ যেন হাজার কষ্টের মধ্যে এক চিলতে সুখ এনে দেয়।কিন্তু আমি চাই না আমার মেয়ে আমার মত হোক।আমার মত কপাল কোন মেয়ের হোক চাই না।আমার মেয়েকে যেন আল্লাহ সকল খারাপ পরিণাম থেকে বিরত রাখে সেই দোআ করি। আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে সব কষ্ট থেকে হেফাজত করে।


এর মধ্যে আমি দরজায় নক দিলাম তাড়াতাড়ি কারন পেটে ক্ষুধায় ফেটে যাচ্ছে।খালা মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছিল ক্ষুধা লেগেছে।তাই তারাহুরা করে মোটা চালের ভাত আর ডাল নিয়ে আসল সাথে করলা ভাজি।আগে করলা ভাজি একদম খেতে পারতাম না।বাবাকে তো বলে বাজার থেকে করলা আনানোই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।আর আজকে করলা ভাজি এত মজা লাগছে কি বলব।মনে হচ্ছে অমৃত খাচ্ছি।কথায় আছে না, পেটে টান পড়লে সবকিছুই ভালো লাগে।খেয়ে একটা লম্বা ঢেকুর তুললাম।মনে হল এত মজার খাবার আর কখনও খাই নি।খেয়াল করলাম রায়ানা এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।রায়ানার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।


হুট করে চোখ গেল খালার গলার দিকে।কাপড় দিয়ে গলাটা পেঁচানো।খালাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?খালা কথা এড়িয়ে যেতে চাইল।খালার গলার আওয়াজ শুনেই বুঝলাম খালার টনসিল ফুলেছে।আর খালা ঔষধ কিনলে টাকা খরচ হবে এই ভয়ে আমাকে কিছু বলছে না।হায়রে জীবনের এ কোন পর্যায়ে এসে পড়লাম।আমি কি আর সুখের মুখ দেখব না।খালাকে যে বলব এক কাপ চা খাও তাও বলার সুযোগ নেই।যেখানে মেয়েকে দুধ খাওয়ানোর চিনি জুটে না তাই চিনি ছাড়া দুধ খাওয়াই সেখানে খালাকে চা খাওয়ার কথা বলাটা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না।আর চা তো ঘরে থাকতে হবে।চোখ দিয়ে আপনা আপনি জল চলে আসল।


অপরদিকে রায়ানা মেয়েটা আমার একদম বিরক্ত করে না। বুঝে গেছে মা অনেক ক্লান্ত।তাই শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।রায়ানাকে বুকে নিয়ে চোখ বুজে রইলাম।হালকা হালকা ঘুম আসছে চোখে।এমন সময় জানালর ওপাশ থেকে একটা কন্ঠস্বরে শুনে ঘুম ভাঙ্গল।।


তাই একটু কৌতুহল নিয়ে জানালা খুললাম।জানালা খুলে দেখলাম প্রমিক প্রেমিকা যুগল দাঁড়িয়ে অভিমানের খেলা খেলছে।মেয়েটা ছেলেটাকে রেগে গিয়ে বলল


-কান ধর না হয় কিন্তু এখনেই বাসায় চলে যাব।


ছেলেটা মেয়েটাকে অপরাধী গলায় বলতেছে


-সরি বলতেছি।সবার সামনে কান ধরলে সবাই কি ভাববে।প্লিজ এমন কর না।আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা কর।ইচ্ছা করে দেড়ি করে নি।৮ টায় আাসার কথা ছিল।জ্যামের জন্য সাড়ে ৮ টা বেজেছে।সরি বলেছি তো।


কিন্তু মেয়েটা বেশ নাছোড়বান্দা বুঝায় যাচ্ছে ছেলেটা কানে না ধরলে মেয়েটা স্থির হবে না।ছেলেটা যতই বুঝাচ্ছে মেয়েটা ততই রেগে যাচ্ছে।অবশেষে মেয়েটার রাগের কাছে হার মেনে ছেলেটা কানে ধরল।নিমিষেই মেয়েটা চুপ হয়ে হেসে বলল।


-হয়েছে আর ঢং করতে হবে না।চল ফুচকা খাই।


মেয়েদের মন কত আবেগী।হালকা একটু ভালোবাসা পেলে গলে যায়।হাজারটা রাগের মধ্যেও সে তার ভালোবাসার মানুষকে ঠিকেই আকড়ে ধরে রাখতে চাই।


মেয়েটার হাসি দেখে ছেলেটা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর একসাথে ফুচকা খেতে বসল।আমি জানালাটা আটকে দিলাম।এ কাহিনী দেখে আড়াই বছর আগের কাহিনী মনে পড়ছে।তখন আমার আর রাজিবের প্রথম বিবাহবার্ষিকী ছিল।রাজিব অফিস থেকে আসতে দেড়ি করেছিল বলে রাজিবকে আমি এক পায়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।হাহাহা।আগের কথা মনে হয়ে এক বিন্দু জল চোখে গড়িয়ে পড়ল।বুঝতে পারছি না এটা কি আনন্দ অশ্রু নাকি অন্য কিছু। হায়রে সময় কত ভাবে মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে মানুষ নিজেও টের পায় না। খুব কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে রাজিব আমাকে ঠকিয়ে হয়ত বেশ সুখেই আছে আর আমি কষ্টের অনলে পুড়ে মরছি।একটা মানুষ এত বড় ছলনা কি করে করতে পারে।এসব ভেবে হুট করে কাঁদতে লাগলাম।কান্নার হালকা আওয়াজ ও হল।খালা উঠে আমার কাছে এসে বলল


-কাঁদিস না মা তোর কষ্টটা আমি বুঝি। তুই কাঁদলে আমার কলিজা ফেটে যায়।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য।বিশ্বাস রাখ একদিন আল্লাহ তোর অবস্থা পরিবর্তন করবে। কষ্ট পাস না।


খালার কথা শুনে আবেগটা আরও ঘন হল।খালাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কান্না করলাম।খালাকে বলতে লাগলাম কি ক্ষতি করেছিলাম আমি।কেন আমার সাথে এমন হল।বাবার মুখটাও দেখতে পেলাম না।তৃনাকেও বাঁচাতে পারলাম না।খালা তৃনার কথা বলতেই হুহু করে কেঁদে দিল।এ বয়সে নিজের মেয়ের লাশ দাফন করেছে এটা কম কষ্টের না।


খালা আর আমি কিছুক্ষণ কেঁদে নিলাম।মনটা বেশ হালকা হল।


কান্না করে শুয়ে পড়লাম।হুট করে আবার প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের আওয়াজ পেলাম।বুঝতে পারলাম আবার ঝগড়া লেগে গিয়েছে দুজনের মধ্যে।আমি তাদের কান্ড দেখে একটু হেসে ঘুমিয়ে গেলাম।কি নাছোরবান্দা মেয়ে হাহা।


পরদিন সকালে অফিসে গেলাম।ম্যানেজার সাহেব অফিসে যাওয়ার সাথে সাথে তার রুমে যেতে বললেন আমি ভয়ে ভয়ে তার রুমে গেলাম তারপর....



পর্ব-৯




ভয়ে ভয়ে ম্যানেজারের রুমে গলাম।কারন বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে।ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ গম্ভীরভাবে বসে আছে।এতে আমার মনের ভয়টা আরও বেড়ে গেল।ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললাম


-স্যার আমাকে ডেকেছেন?


ম্যানেজার গম্ভীর গলায় বললেন


-চেয়ারটায় বসুন।


কথাটা শুনার পর বেশ ভয় লাগছে। কারন আমার কেন জানি না হাত পা কাঁপছে।কেন জানি না মনে হচ্ছে চাকুরী টা চলে যাবে।আর চাকুরীটা চলে গেলে আমি কি খাব কি করব।এসব চিন্তা করতে করতেই ম্যানেজারকে ঠাস করে বলে ফেললাম


-আমার কাজে ভুল হলে আপনি আমাকে বলুন।আমি পরের বার আর সে কাজটা ভুল করব না।তবে আমার কাজটা কেড়ে নিবেন না।এ চাকুরীটা আমার খুব দরকার।এ চাকুরীটা না থাকলে আমি আর আমার মেয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।দয়াকরে আমার চাকুরীটা নিবেন না।কোন ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করে দিন।


ম্যানেজার আমার মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাকের দৃষ্টিতে তাকাল।হয়ত উনি ভাবতে পারেন নি আমি এমন কথা বলব।আমার দিকে তাকিয়ে বলল


-আপনি আগে একটু বসুন।তারপর আমি কি বলি শুনুন। তারপর কথা বলুন।কথা শুনেই আপনি এত কথা বলছেন কেন?আমাকে তো কথা শেষ করতে দিবেন।


আমি কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলাম।তারপর ম্যানেজার বলল


-মিসেস সাদিয়া আমি আপনার কাগজপত্র গুলো দেখলাম।আপনি তো বেশ শিক্ষিত তাহলে এ কাজ টা নিয়েছেন কেন?আপনার যোগ্যতা অণুযায়ী তো এর চেয়ে ভালো চাকুরী ডিজার্ভ করুন।তাহলে এমন একটা চাকুরী নিলেন যে?


আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম


-এসময় আমার চাকুরীটা খুব দরকার।যোগ্যতা অণুযায়ী চাকুরী পাচ্ছিলাম না তাই নিয়েছি।তবে দয়াকরে চাকুরীটা থেকে বাদ দিবেন না প্লিজ।


ম্যানেজার হাসতে হাসতে বলল


-বাদ দিব কেন।গত কালকে আপনার পারফমেন্স আমার বেশ ভালো লেগেছে।আপনার কথার বচনভঙ্গি বেশ সুন্দর।আর সাবলীল ভাষায় কথা বলুন।আপাতত এটাই বলার জন্য ডেকেছিলাম।বুঝতে পেরেছি আপনার চাকুরী টা খুব দরকার তাই হয়ত মাথায় চাকুরী হারানোর ভয় কাজ করছে বেশি।যাইহোক মন দিয়ে কাজ করুন।


আমার মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস আসল।মনটা বেশ শান্ত হল।কাজে গিয়ে মন দিলাম।পারভীনকে দেখলাম কাজ করছে।পারভীন আমাকে দেখে আমার কাছে এসেই বলা শুরু করেছে


-কি গো কেমন আছ?


-হুম ভালো


এ বলে আমি ব্যাগ থেকে তার ব্লাউজটা বের করে বললাম


-কালকে ব্লাউজটা দিয়ে বেশ উপকার করেছ। সারাজীবন মনে থাকবে।


পারভীন একটা হাসি দিয়ে বলল


-আরে কি এমন করলাম বল।যাইহোক তুমি কিন্তু বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।


আমি হাসতে হাসতে বললাম


-তুমিও বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।


তারপর দুজন হাসতে হাসতেই কাজ করতে লাগলাম।প্রতিদিনেই পারভীন ক্যান্টিনে নিয়ে যেতে চাইলে যেতাম না।রিকশায় যেতে বললেও যেতাম না।তাই পারভীন আমার মত বাসা থেকে খাবার আনা শুরু করল।হেঁটে যাওয়াও শুরু করল।


প্রতিদন অফিস, পারভীন এর সাথে একটু আড্ডা আর জানালা দিয়ে সেই প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের প্রেম দেখা যেন একটা রুটিনের মধ্যে পড়ে গেল।আর আমার মিষ্টি মেয়ে রায়ানা তো আছেই।খাওয়া পড়ার একটু কষ্ট হলেও বেশ শান্তিতে আছি এখন।কেউ খুঁচা দিয়ে কথা বলে না।কেউ বাজে কথা বলার সাহস পাই না এটাই তো অনেক।


কেটে গেল ১ টা মাস।আজকে আমার বেতন দেওয়ার কথা।মাসশেষে বেতন টা যেন অনেকটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মত।হাসি মুখে ম্যানেজারের রুমে গেলাম বেতন আনতে।কিন্তু বেতনটা খুলে বেশ অবাক হলাম।


কারন ম্যানেজার আমাকে ২ হাজার টাকা বেশি দিয়েছে।আমার মনে হল হয়ত উনি ভুল করে বেশি দিয়েছে তাই দৌঁড়ে গিয়ে বললাম


-স্যার আপনি মনে হয় ২ হাজার টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছেন।


উনি হাসতে হাসতে বলল


-আমি আপনাকে খুশি হয়ে দিয়েছি।প্রতিটা গ্রাহক আপনার উপর সন্তুষ্ট।তাই ২ হাজার বাড়িয়ে দিয়েছি এটা আপনার প্রাপ্য।


সত্যি বলতে এ অসমময়ে ২ হাজার টাকা বেশি পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।আমি তো খুশিতে অফিসে বসেই টাকা ভাগ করে ফেললাম


বাসা ভাড়া দিব-৫০০০ টকা
বাজার সদাই করব-৪০০০ টাকা
রায়ানর জন্য ভাঙ্গব-১ ০০০টাকা
বাকি থাকবে ৪ হাজার টাকা এর মধ্যে ১ হাজার টুকিটাকি খরচের জন্য রেখে দিব।আর তিন হাজার জমিয়ে রাখব।টাকা গুলো সেভাবে ভাগ করে করে রাখলাম।


পারভীন আমার টাকা ভাগ করা দেখে বলল


-তুমি টাকা গুলো এভাবে আলাদা করে করে রাখতেছ কেন?


আমি পারভীন কে বললাম


-এ মাসে কিভাব কোথায় খরচ করব তা আলাদা করে রেখেছি।


-বাহ তুমি তো বেশ হিসাবী।


আমি মৃদু হাসি দিয়ে বললাম


-হিসাব করে না চললে পরে অনেক বিপদে পড়তে হয়।আর বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায় এর আগে না।তাই আগে থেকেই হিসাব করে চলা ভলো।


পারভীন বলল


-আমি তো সব টাকা রেস্টুরেন্টে খেয়ে আর মেক আপ কিনে ভেঙ্গে ফেলি।


জবাবে আমি বললাম


-তুমি চাকুরীটা পার্টটাইম হিসেবে করলেও আমি চাকুরীটা পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য করি।


পারভীন এবার নিশ্চুপ হয়ে বলল


-আল্লাহ তোমার সকল কষ্ট দূর করে দিক।


আমিও স্বস্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম


আমীন।


অফিস শেষে দুজন হাঁটা শুরু করলাম।পারভীন বলল


-কালকে অফ ডে আর আমার জন্মদিন।তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায় আসবা কিন্তু।তোমার মেয়েকে দেখার খুব শখ।


আমি বললাম


-পারভীন আসতে পারব না।বাসায় অনেক কাজ আছে।অন্য একদিন আসব।


পারভীন নাছোরবান্দা যতই না করতেছিলাম ততই পাগল করে দিচ্ছিল।অবশেষে রাজি হলাম।


পারভীনের বাসার গলিটা আমার বাসার গলি থেকে আগে তাই পরভীন বাসায় চলে গেল।আর আমি আমার বাসার পথে হাঁটতে লাগলাম।মুদি দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় গেলাম।বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দিলাম।


রায়ানা কোলে নিয়ে হাসতে লাগলাম।আজকে বেশ খুশি লাগছে।খালা আমার পাশে এসে বলল


-কিরে মনটা বেশ খুশি মনে হচ্ছে?


-হ্যা খালা অনেক খুশি লাগছে।আল্লাহ আমার সব কষ্ট দূর করে দিবেন একদিন।


খালা হাসতে হাসতে বলল


-তাই যেন হয়।


কিন্তু পারভীনের জন্য কালকে কি নিয়ে যাব।দামি কিছু নেওয়ার মত সাধ্য হবে না।অনেক ভাবলাম।অবশেষে ভাবনার পরে মনে হল।পুডিং বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না।আসার সময় দুধ কিনে নিয়ে এসেছিলাম।তাই হাফ কেজি দুধের মধ্যে মাত্র একটা ডিম দিয়ে পুডিং বানানোর জন্য প্রস্তুত করলাম।


প্রস্তুত করতে করতে হুট করে জানালা দিয়ে প্রমিক প্রমিকা যুগলের আওয়াজ আসল।আর আমারও রোজকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাদের ঝগড়া দেখে।তাই দেড়ি না করেই জানালাটা খুললাম।খুলে দেখতে থাকলাম।প্রতিদিনের মতই মেয়েটা রাগ করে বসে আছে আর ছেলেটা রাগ ভাঙ্গাচ্ছে।তাদের এ ঝগড়াটা আমার বেশ মিষ্টি লাগে।প্রতিদিনেই কোন না কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবে আবার থেমে যাবে।হুট করেই যেন মেঘ আবার হুট করেই যেন বৃষ্টি হওয়ার মত।মাঝে মাঝে ছেলেটার অবস্থা দেখে বেশ হাসি পায় আর মনে মনে বলি কি যে এক পাগলের পাল্লায় পড়ল।কিন্তু তাদের মধ্যে যে ভালোবাসাটা প্রখর তা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল।""মানুষের মধ্যে যখন ভালোবাসার পরিমাণ টা বেড়ে যায় তখন অভিমানের পরিমাণটাও বেড়ে যায়।তাদের অবস্থাটাও ঠিক এমন।"""


তাদের রাগ অভিমানের পালা দেখে মুচকি হেসে জানালাটা লাগিয়ে দিলাম।


আবার আমি পুডিং বানানো শুরু করলাম।অনেকদিন পর পুডিং বানাচ্ছি। বেশ ভয়ে ভয়ে বানাচ্ছি যদি নষ্ট হয়ে যায় এ ভেবে।


অবশেষে আমার পুডিং নষ্ট না হয়েই সুন্দর ভাবে হয়েছে।বাহ মনটা বেশ প্রশান্ত লাগছে।পুডিং বানানো শেষ করে আবার একটু জানালা টা খুলে খেয়াল করলাম প্রমিক প্রমিকা যুগল একটা রিকশা ভাড়া নিল।রিকশায় উঠে একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে যাচ্ছে। কি অপূর্ব এ দৃশ্য।দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।


জানালাটা লাগিয়ে রায়ানাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।সকালে ফজরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গল।
আমার রব আমাকে তার দিকে ডাকতেছে।আমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম।উঠে অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম।সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম।আমার চোখ দিয়ে তখন অজোরে জল পড়ছে।তবে আজকের জলটা ছিল আনন্দের আর শুকরিয়ার।


নামাজ শেষে একটা আয়াত মনে।আয়াত মনে হয়ে মনটা বেশ শান্ত হল।আয়াতটা হল


"তোমরা শুকরিয়া আদায় কর আমি তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দিব"


সত্যিই আল্লাহ তা করেন।মন থেকে একটা শুকরিয়ার নিঃশ্বাস ফেললাম।তার মধ্যে খেয়াল করলাম রায়ানা উঠে আআআ.... আআআআ... করছে।রায়ানাকে কোলে নিয়ে কথা বলতে লাগলাম।পৃথিবীর সবচেয়ে ভিত্তিহীন গল্পগুলো আমরা বাচ্চাদের সাথে করে থাকি।যেমন


"রায়ানাকে নিয়ে চাঁদের দেশে ঘুরতে যাব।চাঁদের আলোয় মুড়িয়ে দিব।চাঁদ মামাকে ধরে এনে রায়ানার কপালে চুমু একে দিব""


আরও কত কি।সত্যি বলতে বাচ্চাদের সাথে আমরা যখন কথা বলি তখন আমাদের মনটাও বাচ্চাসুলভ হয়ে যায়।আর বাচ্চাসুলভ মনেই ভিত্তিহীন কথার স্থান পায়।


রায়ানা আআআআআ....আআআআ.... করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।রায়ানাকে শুইয়ে আমি ঘরের বাকি কাজ শেষ করলাম।পারভীন বারবার বলে দিয়েছিল ১২ টার মধ্যে ওর বাসায় থাকতে।তাই রায়ানাকে গোসল করিয়ে নিজে গোসল করে নিলাম।তার উপর আজকে অফ ডে বেশ কিছু কাজ হাতে রেখে দিয়েছিলাম।খালা আমার তারাহুরা দেখে বলল


-সাদিয়া বাকি কাজ আমি সামলে নিব।তুই আর রায়ানা রেডি হয়ে চলে যা।


আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খালাকে জড়িয়ে ধরে বললাম


-তুমি আছ বলেই যুদ্ধটা আরও সহজ হয়েছে।দুপুরে কিছু রান্না করে খেয়ে নিও।আবার না খেয়ে থেক না।আমি কিন্তু এসে দেখব খেয়েছ কিনা।


খালা হাসতে হাসতে বলল


-আর শাসন করতে হবে না আমি খেয়ে নিব।তুই সাবধানে যা।রায়ানার খেয়াল রাখবি।


আমি হাসতে হাসতে রায়ানা রেডি করাতে নিলাম।খেয়াল করলাম আমার মেয়েটার তেমন ভালো জামা নেই।তবুও কোনরকমে একটা জামা পড়িয়ে রেডি করে নিলাম।কিন্তু রায়ানাকে বাড়তি খরচ হবে তাই ডায়পার পড়ায় নি কখনও।আজকে পারভীনের বাসায় গেলে তো ডায়পার লাগবে।আর ঘরে ডায়পারও নেই।কি আর করা দৌঁড়ে বাইরে গিয়ে ১২৫ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট ডায়পার কিনলাম।তারপর রায়ানাকে একটু গুছিপে রেডি করে নিলাম।তারপর নিজে রেডি হলাম।


এরপর পারভীনের বাড়ির পথে রওনা দিলাম।১০ মিনিট হাঁটার পর পারভীনের বাসার মোড়ে গিয়ে পারভীন কে কল দিলাম।পারভীন আমার কল পেয়েই মোরে আসল আমাকে নিয়ে যেতে।পারভীন রায়ানা দেখে অনেক খুশি হল।রায়ানাকে দেখেই কোলে নিয়ে নিল।আর আমার মেয়েটাও সবার কোলে যায়।খুব মিশুক হবে আমার মেয়েটা এখনেই বুঝা যাচ্ছে।রায়ানা পারভীন এর কোলে গিয়ে একদম বুকের সাথে মিশে গেল।পারভীন আমাকে হাসতে হাসতে বলল


-তোমার মেয়ে তো বেশ মায়া লাগাতে পারে।দেখ একদম বুকের সাথে মিশে গেছে।


আমি হাসতে হাসতে বললাম


-তোমার মত খালামনি পেলে যে কেউ বুকের সাথে মিশে যাবে।


তারপর আমি আর পারভীন ওর বাসার সামনে গেলাম।পারভীন বাসার কলিং বেল চাপল।টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে কলিং বেল এর।খানিকক্ষণ পর একজন দরজা খুলল।বাসায় ঢুকেই চমকে গেলাম কারন...



পর্ব-১০




বাসায় ঢুকেই চমকে গেলাম কারন একটা পাগলি পারভীন এর কোল থেকে রায়ানা নিয়ে দৌঁড়ে অন্যরুমে চলে গেল।আমি তো ভয়ে কাঁপতেছিলাম পাগলীটা যদি রায়ানাকে কিছু করে বসে এ ভেবে।আমি কাঁপা কাঁপা গলায় পারভীনকে বললাম


-পারভীন রায়ানাকে নিয়ে কোথায় গেল উনি।উনাকে দেখে তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।যদি কিছু করে বসে।


পারভীন আমাকে আশ্বস্ত করে বলল


-কিচ্ছু করবে না।বরং আরও আদর করবে।তুমি একদম চিন্তা কর না।তোমার রায়ানার কিছু হবে না।তেমার রায়ানা উনার কাছে ভালো থাকবে।


আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম


-আচ্ছা উনি কে হয় তোমার?


পারভীন হাসতে হাসতে বলল


-আমার মা হয়।


পারভীনের এ কথাটা শুনে আমার তৃনার কথাটা বেশি মনে পড়ল।বেচারী তৃনা বেঁচে থাকলেও হয়ত এরকম পাগলামি করত আর রায়ানা আদর করত।তৃনার কথা মনে হতেই অজানা কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।আপনা আপনিই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।তৃনাকে বড্ড মনে পড়ছে।মনে পড়ছে তৃনার একটা কথা। তৃনা বলত


-আপু আমার মেয়েকে চুলে বিনুনি করে দিব।খোপা করে দিব।আমার মেয়েকে সবসময় সাজিয়ে রাখব।রঙবেরঙ এর জামা পড়াব।


আর আজকে ওর মেয়েকে আমি কিছুই দিতে পারছি না।"সময়ের করাল গ্রাসে সবকিছু উলট পালট হয়ে গিয়েছে।"হুট করে পারভীন ধাক্কা দিয়ে বলল


-কাঁদছ কেন তুমি।কি হয়েছে?আমি কি তোমাকে কোন কষ্ট দিয়ে ফেললাম।


আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম


-আরে ঐরকম কিছু না।আমার জীবনের একটা কথা মনে হল তো তাই চোখে জল চলে এসেছে।


পারভীন শান্ত গলায় বলল


-কি কথা আমি কি জানতে পারি?


-পরে একদিন বলব নে।আর এই যে তোমার জন্য পুডিং এনেছি।আমার তো দামি কিছু দেওয়ার সাধ্য নেই।তাই নিজের হাতে বানিয়ে কিছু নিয়ে আসলাম।


পারভীন হাসতে হাসতে আমার হাত থেকে পুডিং এর বাটিটা নিয়ে বলল


-আরে এতেই আমি খুশি। আমার পুডিং অনেক পছন্দের।খুব মজা করে খাব।এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। চল ভিতরে চল।


তারপর আমি পারভীন এর সাথে ভিতরে গিয়ে বসলাম।খেয়াল করলাম পাগলিটা আমার মেয়ের সাথে খেলছে।বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে একদম।


সত্যি বলতে বাচ্চারা সত্যি এবং মিথ্যা ভালোবাসার তফাৎ বুঝতে পারে।কেউ যদি তাকে মন দিয়ে ভালোবাসে তাহলে বাচ্চারা তার সাথে একদম মিশে যেতে চায়।রায়ানা আর পাগলিটার ভালোবাসা দেখে আবারও তৃনার কথা মনে পড়ে গেল।তৃনা থাকলে হয়ত এভাবেই তার মেয়েকে আদর করত।


এসব ভাবতে ভাবতেই পারভীনের গলার আওয়াজ শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বের হলাম।পারভীন কাকে যেন বলতে লাগল


-মা, মা সাদিয়া এসেছে।কিছু নাস্তা দাও আগে।


ওপাশ থেকে একজন মহিলা বলতে লাগল


-তুই ঐখানে বসতে বল।আমি নাস্তা নিয়ে আসতেছি।ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে দে।আমি শরবতটা বানিয়ে নিয়ে আসতেছি।


আমি বুঝলাম না পাগলিটা যদি পারভীন এর মা হয় তাহলে ঐ মহিলাকে মা ডাকছে কেন।হয়ত চাচী হয় আর চাচীকে মা ডাকছে।আমি পারভীনকে বললাম


-কাকে মা ডাকছ?তোমার চাচীকেও কি তুমি মা ডাক?


তারপর পারভীন আমাকে যা বলল তা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।কারন পারভীন বলল


-উনিও আমার মা।


আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস জরলাম


-তাহলে এ পাগলি টা কে?


পারভীন হাসি গলায় বলল


-উনিও আমার মা।


পারভীনকে আমি বিস্ময়ের স্বরে প্রশ্ন করলাম


-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।দুজন তোমার মা হয় কি করে।আমাকে একটু বুঝিয়ে বল


পারভীন মুচকি হেসে বলল


-এই যে পাগলিটা দেখছ রায়ানাকে নিয়ে খেলছে উনি আমার জন্মধাতৃ মা।আমার জন্মের এক বছর পরেই পাগল হয়ে গিয়েছে।এরপর থেকে বাবা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল আমাকে নিয়ে।আমাকে দেখাশোনা করার মত কেউ ছিল না।তখন বাবার এক বন্ধু দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলল।দাদীর মুখে শুনেছি বাবা তখন রাজি হয় নি দ্বিতীয় বিয়ে করতে।তবে দাদীর জোরাজোরিতে দ্বিতীয় বিয়ে করে।আর ঐ যে রান্না ঘরে এতক্ষণ যাকে মা ডেকেছিলাম উনি আমার ছোট মা।


আমি পারভীন এর কথা শুনে অনেক বিস্মিত হলাম।কারন দ্বিতীয় বিয়ের পর ও একটা সংসার এত ভালোভাবে টিকে রয়েছে সেটা যেন আমার বিশ্বাসের বাইরে।তার উপর দুজন মহিলায় সুখে আছে। তাদের দেখই বুঝা যাচ্ছে।আমার বিস্ময়ের পরিমাণ টা বেড়ে গেল।পারভীনকে জিজ্ঞেস করলাম


-তোমার ছোট মা কে নিয়ে তোমার বাবা আর মায়ের মধ্যে কখনও ঝগড়া হয় নি।


পারভীন মৃদু গলায় জবাব দিল


-একেবারে ছোট বেলার কথা বলতে পারছি না।তবে বুঝ হওয়ার পর থেকে এসব নিয়ে কখনও ঝগরা হতে দেখি নি।বাবা দুজনকেই সমানভাবে রেখেছে।বাজার থেকে যা এনেছে দুজনকে সমান করে দিয়েছে।কখনও এসব নিয়ে কেউ অভিযোগ করতে পারে নি।বাবা আমার মায়ের কাছে থাকত ১৫ দিন।আর ছোট মায়ের থাকত ১৫ দিন।কোনকিছু হলে আমার মা পাগল হলেও দুজনকে বসিয়ে পরামর্শ নিয়ে করত।সত্যি বলতে বাবা যা করেছে সমান ভাবে করেছে।আমার মা তো পাগল কখনও কিছু নিয়ে অভিযোগ করার সময় পাই নি।আর ছোট মা ও বাবাকে অভিযোগ করতে পারে নি।কারন বাবা দুজনের দায়িত্ব সমানভাবে পালন করেছে।


পারভীন কথা গুলো বলে আমাকে পুনরায় বলল


-চল আমার সাথে দুজনের ঘর দেখলেই বুঝবা।এ বলে আমাকে পাশাপাশি দুইটা রুমের কাছে নিয়ে গেল।আমি দুইটা রুমের ভিতর দেখে আমার বিস্ময়ের পাল্লাটা যেন আরও বেড়ে গেল।কারন দুইটা রুমেই একইরকম আসবাপ পত্র।একটা সুতাও মনে হয় পার্থক্য নেই।দুই রুমে সব এক।বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-দুইটা রুমে একই রকম আসবাপপত্র কেন?


-কারন দুইটা রুম দুই মায়ের।বাবা সবসময় সমতা বজায় রেখেছে।কাপড় আনার সময়ও বাবা দুজনের জন্য একই রকম আনে।তাই এসব দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কখনও ঝামেলা হয় নি।


-আচ্ছা তোমার ছোট মা তোমাকে আদর করে কেমন?আর তার কি কোন বাচ্চা হয় নি?


-আমার ছোট মা নিজের মায়ের থেকেও বেশি আদর করে।আর আমার একটা ছোট বোন হয়েছে ও মাদ্রাসায় পড়ে।ঐখানেই থাকে।


পারভীন এর কথা গুলো শুনে আমার মনে একটাই কথা বাজতে লাগল।সত্যিই কি আমার সংসারটা দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ভেঙ্গেছিল?নাকি অন্য কিছু? নাহ আমার সংসারটাও দ্বিতীয় বিয়ের পরেও সুন্দরেই থাকত।কিন্তু বিয়েটাকে বিকৃত করেছে রাজিব।আমার মানুষ নির্বাচনে ভুল ছিল।রাজিব আমার সাথে অন্যায় করেছে।সম্পদের লোভে আমাকে ঠকিয়েছে। একটা সংসার যে সামান্য দুইটা বিয়ের জন্য ভাঙ্গে না পারভীন এর পরিবার তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।রাজিব মানুষটাই খারাপ ছিল।সে তো ইচ্ছা করেই আমার মাতৃত্ব নষ্ট করেছে।ইচ্ছা করেই আমার সাথে এমন করেছে।রাজিব চাইলেই পারত আমার আর তৃনার জীবনটা সুন্দর করতে।দ্বিতীয় বিয়ে সংসার নষ্ট করে না।সংসার নষ্ট হয় একটা সঠিক মানুষের অভাবে।


আগের কথা মনে হয়ে বুক ফেটে কান্না আসছে।পারভীন আমার দিকে তাকিয়ে বলল


-আচ্ছা সাদিয়া আমাকে কি বলবে তুমি হুটহাট কেন কেঁদে বস।তোমার মনে কি এমন কষ্ট আমাকে একটু বলবে।


আমি চুখ মুছতে মুছতে বললাম।এক জায়গায় বসি চল তারপর সবটা বলি।এর মধ্যেই খেয়াল করলাম পারভীন এর ছোট মা এসেছে।এসে আমাকে বলল


-তুমিই মনে হয় সাদিয়া।পারভীন এর মুখে তোমার অনেক কথা শুনেছি।বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।আর আমার মেয়েটার তো কোন আক্কেলেই নেই ওকে একটু গুছিয়ে চলতে বল তো।কত করে বলি কয়েকদিন পর বিয়ে দিব ছেলেমানুষী ছাড়।তার তো আমার কথায় হুশেই আসে না।


পারভীন আন্টিকে থামিয়ে বলতে লাগল


-এই তো শুরু হয়ে গেল তোমার বিচার দেওয়া।যাকে পাও তার কাছেই বিচার দাও।সাদিয়াকেও রক্ষা দিলে না।তুমি পারও মা।


আন্টি পারভীনকে ঝাড়ি দিয়ে বলল


-তুই চুপ কর।আমাকে বলতে দে।


এ বলে আন্টি পারভীন এর নামে নালিশ করতে লাগল।আন্টি যেভাবে নালিশ করতে লাগল মনেই হচ্ছে না পারভীন আন্টির সৎ মেয়ে।কারন ভার্সিটি পড়ার সময় আমি কোন বান্ধবীর বাসায় গেলেও আমার বান্ধবীর মায়েরা এভাবে নালিশ করত তাদের নামে।আন্টির কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে বললাম


-সব ঠিক হয়ে যাবে আন্টি। চিন্তা করবেন না।


আন্টি মৃদু হাসি দিয়ে বলল


-এবার নাস্তা খেয়ে নাও।আর আমি রেহানাকে নাস্তা দিয়ে রায়ানা নিয়ে আসি।না হয় রায়ানাকে নিয়েই খেলতে থাকবে।


মনেই হচ্ছে না পাগলিটা আন্টির সতীন।কি চিন্তা নিজের সতীন এর নাস্তা নিয়ে।হাহাহা।।সত্যিই রাজিব চাইলেও আমার সংসারটাও এমন হত।কিন্তু মানুষ টা ছিল ভুল।আমি নাস্তা খেতে লাগলাম।পারভীন এর ছোট মা রায়ানাকে নিয়ে এসে বলল


-সাদিয়া মেয়ের ক্ষুধা পেয়েছে ওকে একটু বুকের দুধ দাও।


আমি আন্টির কথা শুনে রায়ানা কোলে নিয়ে ফিডার বের করে খাওয়াতে লাগলাম।আন্টি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল


-রায়ানার কয় মাস চলে।


আমি হাসতে হাসতে বললাম


- ৪ মাস।


আন্টি একটু রাগী গলায় বলল


- এ বয়সে বাইরের দুধ খাওয়াচ্ছ কেন?মেয়ের তো মাথায় বুদ্ধি হবে না।ফিডার রাখ তো বুকের দুধ দাও ওকে।


আমি কি বলব আন্টিকে বুঝতে পারছিলাম না।সব মিলিয়ে আমার বেশ কান্না পাচ্ছিল।আমি আবেগ সামলাতে না পেরে ধুম করে কেঁদে দিলাম।আমার কান্না দেখে সবাই হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল কি হয়েছে।আমি কাঁদতে কাঁদতেই আন্টিকে, পারভীনকে আমার জীবনের সবটা ঘটনা খুলে বললাম।জীবনের পার করে আসা কালো অধ্যায়টা বললাম।আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল


-এ বয়সে অনেক কষ্ট সহ্য করেছ।পারভীন এর বাবা কখনও আমাকে বিয়ের পর রেহানাকে ফেলে দেয় নি।আমি আর রেহানা সবসময় একই আদর পেয়েছি।ঐ ছেলে তো তোমাকে প্রথম থেকেই ভালোবাসে নি।একটা নাটক করেছে।শুন মা বিয়ে হালাল বন্ধন।দুইটা বিয়ের পরও অনেক পরিবার সুখে আছে।আবার এক বিয়েতেও অনেকে সুখী নেই।তোমার মানুষটা সঠিক হলে সবভাবেই তুমি সুখী হতে।কষ্ট দিয়ে ফেললাম সবকিছু মনে করিয়ে দিয়ে।কষ্ট পেও না।যা হবে ভালোর জন্য।আল্লাহর উপর ভরসা হারাবে না।


পারভীন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল


-হাসি মুখের আড়ালে যে এত কষ্ট ছিল একবার বলতে পারতে।হয়ত হালকা লাগত।


আমি কাঁদতেই লাগলাম।তাদের ভালোবাসা মাখা স্পর্শ পেয়ে কান্না থামালাম।আন্টি বলল


-ছোট বেলায় মা হারিয়েছ কি হয়েছে।তোমার কিন্তু এখন থেকে চারটা মা হয়েছে।আমি,রেহানা,তোমার মেয়ে রায়ানা আর তোমার খালা।আর কিছুর অভাব হবে না তোমার।জীবন পাল্টে যাবে দেখ।


আমি কান্না থামিয়ে নিজকে সামলে নিলাম


তারপর খাওয়া দাওয়া করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পারভীন এর বাসা থেকে বিদায় নিলাম।আজকে পারভীন এর বাসা থেকে অনেক কিছু শিখলাম।সত্যি বলতে সব জায়গা থেকে মানুষ শিখতে পারে।মানুষের শিখার শেষ নেই।


"প্রকৃতির সবকিছুই যেন একটা শিক্ষাক্ষেত্র।"


বাসায় এসে খালাকে সবটা বললাম।খালাও একই কথা বলল। খালা বলল


-কত মানুষের বাচ্চা হয় না আরেকটা বিয়ে করে তারাও তো সুখী আছে রে মা।আর রাজিব তো তোর মাতৃত্ব ইচ্ছা করে নষ্ট করেছে।তৃনাকে ব্যবহার করেছে।রাজিবের মত ছেলের কাছে ভালো আশা করা যায় না।তোর সংসার নষ্টই হত।মাঝখানে তৃনা দ্বিতীয় বিয়ে এগুলা কিচ্ছু না রে মা।তোর তো গোড়ায় গলদ হয়েছে।মানুষ নির্বাচন করতেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিস।


আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম সত্যিই মানুষ নির্বাচন করতে বড্ড ভুল করে ফেলেছি।কিন্তু কি করব


"অমানুষেরাও তো মানুষের খোলস পড়ে থাকে।মানুষ আর অমানুষগুলোরে দেখতে যে একই রকম লাগে।"


রায়ানাকে কোলে নিয়ে হাসতে লাগলাম।রায়ানাকে দেখলে নিমিষেই আমি অতীত ভুলে যাই।রাতে আবার সেই প্রমিক প্রমিকা যুগলের কন্ঠ ভেসে আসল।তাদের ভালোবাসার মায়া জড়ানো কথা গুলো শুনার জন্য আবার জানালা খুলে দেখতে লাগলাম।আজকে মেয়েটা মাথায় হিজাব পড়ে এসেছে।মেয়েটাকে ছেলেটা এ নিয়ে বেশ প্রসংশা করছে।আর মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।


"সত্যিই মেয়েরা খুব প্রসংশা প্রিয় মানুষ।মেয়েদের পটানোর একটা বড় অস্ত্র হচ্ছে প্রসংশা।মেয়েদের প্রসংশা দিয়েই সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে মাত্রা অতিরিক্ত প্রসংশায় মেয়েদের বদহজম হয়
তাই প্রসংশার মাত্রাটা সবসময় ঠিক রাখা জরুরি।"


বুঝায় যাচ্ছিল ছেলেটা মেয়েটার মাত্রার মধ্যেই প্রসংশা করছে।তাদের এ ভালোবাসার সম্পর্কটা আমার কাছে বেশ ভালো লাগে।একটা মাসে যত সমস্যাই হোক না কেন তাদের এ জায়গায় আসতে মিস হয় নি।কিভাবে যে চলে আসে এ কপোত কপোতি কে জানে।


হালকা হেসে জানালা লাগিয়ে দিলাম


সুখ দুঃখ মিলিয়ে কেটে গেল আরও ৩ টা মাস।রায়ানা এখন একটু একটু করে ডাকতে শিখেছে।আম্মা.... আম্মা....করে ডাকে।আমার মেয়ে প্রথম আমাকেই ডেকেছে।


"সন্তানের মুখে যে মা ডাক শুনা কত মধুময় তা মা ডাক না শুনলে বুঝা সম্ভব না।"


অপরদিকে অফিসের কাজেও বেশ মন দিতে লাগলাম।একদিন পারভীন এসে আমাকে বলল


-ম্যানেজার স্যার তোমাকে ডাকছে হয়ত কোন ঝামেলা হয়েছে। কি করে কে জানে।তুমি তাড়াতাড়ি যাও।


আমার ভিতর টা চাকুরী হারানোর ভয়ে আৎকে উঠল।মনে হল বেশি সুখ তো আমার কপালে সয় না।আমার কপালে কি এ সুখটাও থাকবে না।ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম।আমি দৌঁড়ে ম্যানেজারের রুমে গেলাম।রুমে গিয়ে খেয়াল করলাম




পর্ব-১১




ম্যানেজারের রুমে গিয়ে খেয়াল করলাম।ম্যানেজার বেশ রাগী মুখে বসে আছে।ম্যানেজারের এরকম মুখ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে হয়ত আমি বড় কোন ভুল করেছি।আমার কপালে এত সুখ সয় না।এ সুখটাও হয়ত সইবে না।চাকুরীটা আর আমার থাকবে না।এরকমেই মনে হতে লাগল বারবার।ভয়ে ভয়ে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললাম


-স্যার আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?


ম্যানেজার রাগী গলায় বলল


-দেখুন মিসেস সাদিয়া আমার মনে হয় না আপনি যে চাকুরীটা করছেন এটার জন্য আপনি পারফেক্ট।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আপনাকে আর এ চাকুরীতে রাখতে পারব না।এজন্য আমরা দুঃখিত।


ম্যানেজারের কথা শুনে বুঝতে পারলাম।আমি যে ভয়টা পেয়েছি সেটাই হচ্ছে।বুকের ভেতরটা মুচর দিয়ে উঠল।আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম।ম্যানেজারের কথা আটকিয়ে দিয়ে বললাম


-স্যার চাকুরীটা যে আমার কি দরকার বলে বুঝাতে পারব না।এ চাকুরীর উপর আমার সংসার চলছে।এভাবে হুট করে আমাকে চাকুরী থেকে বাদ দিলে আমি যে পথে বসব।আমার ভুলটা আপনি একটু বলুন।আমি শুধরে নিব।তবুও এরকম করবেন না দয়াকরে।বাসায় আমার একটা ছোট্র মেয়ে আছে।ওকে দুধ খাওয়ানোর টাকাও হবে না যদি চাকুরীটা চলে যায়।আমাকে দয়া করুন


ম্যানেজার স্তম্ভিত বলল


-দেখুন আপনি এ পদের জন্য যোগ্য থাকলে আপনাকে রাখতে তো আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা না।আমাদের সবার মনে হল আপনি এ পদের জন্য যোগ্য না।এজন্য দুঃখিত।


আমি ম্যানেজারকে কাকুতি মিনতি করে বললাম


-আমার ভুলটা কোথায় আমাকে একটু বলুন।আমার নামে তো কেউ অভিযোগ করে নি। তাহলে আমার চাকুরীটা কেন নিয়ে যাচ্ছেন।দয়াকরে আরেকটা সুযোগ দিন।


ম্যানেজার শান্ত হয়ে বলল


- এ পদের জন্য আপনাকে আর সুযোগ দেওয়া যাবে না।এজন্য দুঃখিত।তবে..


আমি ম্যানেজারের কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বললাম


-তবে কি বলুন?


ম্যানেজার হাসতে হাসতে বলল


-তবে আমাদের মনে হল আপনি এর চেয়ে বড় পদে চাকুরী পাওয়ার যোগ্য।আমাদের একজন বড় পদ থেকে চাকুরীচ্যুত হয়েছে।তাই নতুন করে নিয়োগ দিয়ে ঝামেলা করি নি কারন আমাদের অফিসে একজন এ পদে চাকুরী করার যোগ্যতায় রয়েছে তাই।


আমি ম্যানেজারের কথার মানেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম


-আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না।আমাকে বুঝিয়ে বলুন।


ম্যানেজার অট্র হাসি দিয়ে বলল


-মিসেস সাদিয়া মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করুন।কারন আপনাকে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।


আমি কথাটা শুনে খুশিতে যেন স্থির হয়ে গেলাম।কারন যে কাজের জন্য আমাকে যোগ দিতে বলছে সেখানে মাস শেষে আমাকে ৩০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে।আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল।নড়তে চলতে পারছিলাম না, কি করব বুঝতে পারছিলাম না।চোখের কোণে এক ফোঁটা জল চিকচিক করতে লাগল।নিমিষেই একটা শীতলতার বাতাস যেন আমাকে দমিয়ে দিল।আমি নিজেকে সামলে ম্যানেজারকে বললাম


-স্যার ধন্যবাদ।আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।আমি বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছি।


ম্যানেজার হাসতে হাসতে বলল


-কখনও মনোবল হারাবেন না।আর এই যে এটা আপনার জন্য কিছু এডভান্স।সবার জন্য এ টাকা দিয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে যান।


আমি টাকা কয়টা হাতে নিয়ে ছুটে পারভীন এর কাছে গেলাম।পারভীনকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।পারভীন আমাকে হাসতে হাসতে বলল


-যে যতটুকু প্রাপ্য সে ততটুকু পাবেই।সাবধানে বাসায় যাও এবার।কালকে থেকে আমার মেডাম তুমি।ভুল হলে মাফ করে দিও হ্যা।হাহাহা


-ধুর কি যে বল না।আচ্ছা আমি বাসায় যাই কারন খালাকে খুশির খবরটা দিতে হবে।


-যাও, সাবধানে যাও।


আমি বাসার পথে রওনা দিলাম।চিন্তা করলাম এডভান্স এর টাকা দিয়ে রায়ানার জন্য কয়েক সেট জামা কিনে নিয়ে যাব।কারন রায়ানার সব জামাগুলো ছোট হয়ে গিয়েছে।এর আগে টাকার জন্য কিনতে পারি নি। খলার জন্যও কিছু কিনে নিয়ে যাব।যেই চিন্তা সেই কাজ। মার্কেটে গিয়ে রায়ানার জন্য জামা কিনলাম, খালার জন্য কাপড় কিনে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।


বাসার সামনে গিয়ে দরজায় নক দিলাম।খালা দরজা খোলার সাথে সাথে খালাকে জড়িয়ে ধরলাম।খালাকে জড়িয়ে ধরে বললাম


-খালা আজকে আমার অনেক খুশি লাগছে।তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।তুমি সত্যিই বলেছিলে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য।আমি যদি তখন হতাশ হতাম তাহলে আজকে এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না।খালা আজকে যে কেমন লাগছে বলে বুঝাতে পারব না।


খালা হাসতে হাসতে বলল


-আরে কি হয়েছে সেটা বলবি তো।তা না বলে বকবক করেই যাচ্ছিস।


আমি চেঁচাতে চেঁচাতে বলতে লাগলাম


-আরে খালা আমার প্রমোশন হয়েছে।আমার বেতন এখন মাসে ৩০ হাজার টাকা।এত অল্প সময়ে আল্লাহ এত সুখ দিয়ে দিবেন বুঝতে পারি নি।খালা আজকে আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে।


এবলে খালাকে পুনরায় বললাম


-দেখ তো খালা রায়ানার জন্য এ জামা গুলো কেমন হয়েছে।রায়ানা ঘুম থেকে উঠলেই নতুন জামা পেয়ে অনেক খুশি হয়ে যাবে তাই না।আর খালা তুমি চোখটা বন্ধ কর তো।


খালা হাসতে হাসতে বলল


- কি পাগলামি করছিস।চোখ বন্ধ কেন করব।


-আরে চোখটা একটু বন্ধ করে দেখ না।


খালা চোখ বন্ধ করে বলল


- হ্যা করেছি এবার বল কি হয়েছে।


আমি খালার হাতে শাড়ির প্যাকেটটা দিয়ে বললাম


-বলত তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?


খেয়াল করলাম শাড়িটা দেখার পর খালার চোখ দিয়ে জল পড়ছে।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম


-খালা কাঁদছ কেন।


খালা আমার মাথাটা তার কাছে নিয়ে বলল


-আরে এটা যে সুখের কান্না।তোর মত মেয়ে যেন সবার ঘরে হয়।এবার চুপ করে খেতে বস।


এর মধ্যেই রায়ানা ঘুম থেকে উঠে মাম্মা মাম্মা করতে লাগল।আমি রায়ানাকে কোলে নিয়ে হাজারটা চুমু একে দিলাম তার গালে তারপর কত কথা যে বললাম মেয়েটার সাথে।আমার মেয়েটা আমার সাথে খিল খিল করে হাসছে।রায়ানাকে একটা নতুন জামা পড়ালাম।লাল জামাটায় রায়ানাকে পরীর মত লাগছে।রায়নাকে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম একদম।


সারাটা দিন কাটল আমার সুখের তান্ডবে।আজকে এতটা খুশি লেগেছে সেটা বলে বুঝানোর ভাষা আমার নেই।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।


হুট করে রাত আট টায় সেই প্রমিকের কন্ঠ ভেসে আসল।আমি জানালা খুলে দেখে অনেক অবাক হলাম কারন
আজকে শুধু ছেলেটা একা এসেছে আর একাই কথা বলতেছে।আমার কাছে ব্যাপারটা কেন জানি গোলমেলে মনে হল।আমি দরজা খুলে ছেলেটার কাছে গেলাম।কাছে গিয়ে বললাম


-এই যে একটু কথা বলতে পারি কি?


ছেলেটার মুখটা খেয়াল করে দেখলাম একদম অন্যরকম হয়ে আছে।বুঝায় যাচ্ছে তার মনে একটা বড়সড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।মায়া মাখা মুখ নিয়ে ছেলেটা বলল


-জ্বি আপু বলুন


-সত্যি বলতে আমি প্রায় সময় জানালা দিয়ে তোমাদের ঝগড়া দেখি।তোমার সাথে যে মেয়েটা থাকে ওর কান্ড দেখে অনেক হাসি।মেয়েটা বেশ মিষ্টি।তোমাদের কেন জানি আমার কাছে বেশ ভালো লাগে।আজকে হঠাৎ আপুটাকে ছাড়া আসলে আর একা কথা বলতেছ এটা দেখে কেন জানি না কেমন লাগছে।আপুটা কোথায় আছে?


ছেলেটা কান্না গলায় জবাব দিল


-সেতারা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।


নামটা বলার পর বুঝতে পারলাম মেয়েটার নাম সেতারা।কিন্তু মেয়েটা কোথায় গেল। বিয়ে হয়ে গেল নাকি প্রশ্নটা মনে ঘুরতে লাগল।তাই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম


-আচ্ছা ওর কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে?


কান্না কান্না গলায় বলল


-আমাকে একেবারে ছেলে চলে গিয়েছে।গতকালকে এখান থেকে যাওয়ার পর মারা গিয়েছে।জানেন আপু একমাস পরে যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আমার সাথে অভিমান করে একমাস আগেই চলে গিয়েছে।কেন এমন করল বলেন তো।ওকে ছাড়া থাকতে যে কষ্ট হচ্ছে ও কেন বুঝল না বলেন।


আমি ছেলেটার কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না।বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার জন্য বললাম


-কি হয়েছে আমাকে খুলে বল


ছেলেটা এবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বলতে লাগল


-সেতারার সাথে আমার পরিচয় ৪ বছর আগে।ইন্টারে পড়ি সময় ওর সাথে প্রথম দেখা।সেখান থেকে বন্ধুত্ব অনার্সে উঠার পর প্রেম হয়।প্রেমের এক বছর পর জানতে পারি সেতারার ক্যান্সার হয়েছে।আর বাঁচবে বড়জোর দেড় বছরের মত।সেতারা অনেক চেষ্টা করল আমাকে ছেড়ে দিতে আমি দেই নি।জীবনের শেষ সময়টাই তাকে একটু সুখে রাখা জরুরি ছিল।সেদিনেই সেতারাকে নিয়ে জোর করে বিয়ে করে ফেলি।শুরু হয় আমাদের সংসার।এ জায়গাটায় আমরা প্রেমের শুরু থেকেই আসতাম।তাই নিয়ম করে এ জায়গায় আসতাম।ডাক্তার বলেছিল যে সেতারা আরও এক মাস বেশি বাঁচবে। কয়েকদিন আগে চুলে ফেলে দিল সব।হিজাব পড়েছিল মেয়েটাকে এত সুন্দর লেগেছিল যে আমি নতুন করে প্রেমে যায়।কিন্তু আপু ও তো সময়ের আগে অভিমান করে চলে গেল।কেন এমন করল বলবেন।


ছেলেটার প্রশ্নের জাবার আমি কি দিব বুঝতে পারছিলাম না।চোখ দিয়ে এমনেই জল পড়তে লাগল।কিছু না বলেই রুমে চলে আসলাম।আর ভাবতে লাগলাম পৃথিবীটা কত বৈচিত্র্যময় কেউ ভালোবাসা মানুষ পেয়েও হারায় আর কেউ আগলে রাখতে চাইলেও আগলে রাখতে পারে না।


এর পর থেকে ছেলেটা নিয়ম করে এখানে আসে আর একা একাই কথা বলে চলে যায়।আমি শুধু ছেলেটার শন্যতাটা দূর থেকে দেখি।


হুট করে কিছুদিন পর



পর্ব ১২/শেষ পর্ব




হুট করে একদিন বাসায় এসে দেখলাম কেউ একজন মিষ্টি আর কিছু জিনিস পত্র পাঠিয়েছে।আমি অবাক হলাম এটা ভেবে কারন কে পাঠাবে এ জিনিসগুলো।এখানে তো আমাদের এত পরিচিত কেউ নেই।আমি অবাক হয়ে খালাকে জিজ্ঞেস করলাম


-খালা এগুলা কে পাঠিয়েছে?


খালা ভয়ে ভয়ে বলল


-তোর অফিসের ম্যানেজার পাঠিয়েছে।


আমি বেশ অবাক হলাম এটা ভেবে যে উনি আমার বাসায় এসব কেন পাঠাল।আমি অবাক হয়ে খালাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম


-ম্যানেজার এগুলা পাঠিয়েছে কেন?


খালা আস্তে আস্তে বলল


-বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।তোকে বিয়ে করতে চায়।আমি বলে কি মা লোকটা তো ভালোই। কথা বলে আমার বেশ ভালো লেগেছে।রায়ানার ও তো বাবার পরিচয় দরকার তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যা।


আমি খালার কথাটা আটকে দিয়ে বললাম


-খালা তুমি কি আমার অতীত ভুলে গিয়েছে।এরপর ও তুমি কাউকে বিশ্বাস করতে বলতেছ।তুমি কি জান না আমি কতটা কষ্ট করেছি?রাজিবকে দেখে কি প্রথমে খারাপ মনে হয়েছিল?খালা মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষগুলোকে কখনও চেনা যায় না।মানুষের রুপ কখন বদলে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না।


খালা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল


-দেখ মা মানুষের জীবনে কত কিছুই ত ঘটে।একজন খারাপ হয়েছে বলে যে সবাই খারাপ হবে তার কি কোন গ্যারান্টি আছে বল।ম্যানেজারকে আমার ভালোই লেগেছে।উনি তোর ব্যাপারে সবটা পারভীন এর কাছে জেনে এসেছে।তুই রাজি হলে ক্ষতি হবে না।আর পারভীন ম্যানেজারকে অনেক আগে থেকে চিনে পারভীন ও বলেছে ম্যানেজার লোকটা অনেক ভালো।


আমি খালার কথা শুনে রাগী গলায় জবাব দিলাম


-আমাকে দয়াকরে আর এসবে জড়িও না।আমি নতুন করে কোন কষ্ট পেতে চাই না।


এটা বলার পর খালা একদম চুপ হয়ে গেল।রাগে শরীরটা গিজগিজ করতে লাগল।রাগটা সামলে রায়ানাকে নিয়ে ঘুমালাম।মনে মনে স্থির করলাম অফিসে গিয়েই ম্যানেজারকে ধরব সবার আগে।চাকুরী থাকলে থাকবে না থাকলে নেই।


কোনরকমে রাতটা পার করে সকালে উঠেই অফিসে ছুটলাম।পারভীন আমাকে দেখেই মুচকি হাসি দিয়ে বলল


-সাদিয়া কিছু ভেবেছ?


আমি রাগ রাগ গলায় বললাম


-ভাবার কি আছে এতে।এসব বিয়ে টিয়ে তে আর জড়াব না বলেই দিয়েছি।জানই তো সব আমার।ছেলেরা ভলো হয় না।


পারভীন আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল


-রাজীবের সাথে সবাইকে তুলনা কেন করছ?আমার বাবাও তো দুই বিয়ে করেছে এ নিয়া তো কোন ঝামেলা হয় নি।তোমার বাবা কি তোমাকে মানুষ করে নি?সব ছেলেরা যদি এক হত তাহলে এরা কি ছেলে না?


পারভীনের কথায় যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও আমি পারভীন এর কথা এড়িয়ে ম্যানেজারের রুমে গেলাম।ম্যানেজার আমাকে দেখে একদম চুপ হয়ে বসে রইল।আমি সরাসরি গিয়েই বললাম


-আপনি আমার বাসায় গিয়েছিলেন.।


ম্যানেজার শান্ত গলায় জাবাব দিল


-হ্যা গিয়েছিলাম।


আমি বললাম আপনি সবকিছু জানার পর এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন কিভাবে।তারপর ম্যানেজার আমাকে যা বলল তা শুনে আমি আৎকে গেলাম।ম্যানেজার আমাকে বলল


-আমার সংসার ছিল, স্ত্রী ছিল।আমার স্ত্রী ২ বছর আগে ১ বছরের একটা বাচ্চা রেখে মারা যায়।এখন আমার ছেলের বয়স তিন।ছেলেকে মায়ের আদর দিতে পারে নি।কিন্তু এদিকে আমার স্ত্রী এর শোক কাটিয়ে উঠতেও বেশ সময় লেগেছে। যার কারনে বিয়ে করে উঠতে পারি নি।ছেলেটাকে মানুষ করার জন্য একটা যোগ্য মা দরকার।কিন্তু ঐরকম যোগ্য মা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।পারভীনকে পাত্রী দেখার কথা বলি।পারভীন আপনার কথা বলে। আপনার সব ঘটনা খুলে বলে।আমার কাছে মনে হল আপনি যেহুত ব্যথাটা পেয়ে এসেছেন একমাত্র আপনিই আমার ছেলের মায়ের আদরের ব্যথাটা বুঝবেন।আর আপনার মেয়ের ও একটা পরিচয় দরকার।সবমিলিয়ে দুজনেই এতে উপকৃত হতাম তাই এই প্রস্তাব রাখা।আপনি রাজি না হলে কোন জোর নেই।আপনি আগের মতই অফিসে কাজ করবেন।তবে বিষয়টা ভেবে দেখার অণুরোধ রইল।


ম্যানেজারের কথা শুনে কেন জানি না একটা অদ্ভূত মায়া কাজ করল।এ মায়া কোথায় থেকে তৈরী হল বুঝতে পারলাম না।তবে নিজেকে সামলিয়ে আমি কিছু না বলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।বাসায় আসার পর খালা আমাকে বুঝাল অনেক।পারভীন ও ফোন দিয়ে বুঝাল।এদিকে রায়ানার দিকে তাকিয়ে মনে হল সত্যিই তো রায়ানার তো একটা পরিচয় দরকার।কি করব বুঝতে পারছিলাম না।দু রাকাত নফল নামাজ পড়লাম।


বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম।আমার কি দ্বিতীয় বিয়ে করা উচিত হবে?বিয়ে করলে যদি আবার ঠকি তখন কি সে ধাক্কাটা মেনে নিতে পারব।কিন্তু বড় হলে রায়ানার বাবার পরিচয় কি দিব।আমি তো রাজিবের পরিচয়ে রায়ানাকে বড় করব না।


অনেক ভাবনার পর একটা সিদ্ধান্তে আসলাম। সন্ধ্যায় ম্যানেজারকে কল দিলাম আর বললাম


-আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।


ম্যানেজার আমার কথা শুনে শুধু একটা কথায় বলল


-আপনাকে আমি কখনও কোন কষ্ট পেতে দিব না।


এরপর ম্যানেজার খালাকে ফোন দিয়ে বিয়ের দিন ধার্য করল।১৫ দিন পরেই আমাদের বিয়ে।আমি বেশ চিন্তায় ছিলাম আমার নতুন জীবন নিয়ে।আমার নতুন জীবন কেমন হবে বেশ ভাবনায় পরে গেলাম।ম্যানেজারের ছেলের নাম রাফসান।তাকে মেনে নিতে পারব তো।এসব চিন্তা শুধু মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।আরেকবার ঠকলে কি করব।কি করে তখন নিজেকে সামলাব।এসব হাবিজাবি ভাবনায় মনে আসতে লাগল।


১৫ টা দিন খুব ছটফটানিতে কাটল।


অবশেষে আমার দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হল।বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম।কারন অতীতে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।কিন্তু ভয় গুলো অরন্য জয় করে নিয়েছিল।


(ওহ ম্যানেজারের নামটা তো বলা হল না ম্যানেজারের নাম তানভীর রহমান অরন্য।)


বাসর রাতে সব মেয়েরা একা থাকলেও বাসর রাতে আমার কোলে ছিল রায়ানা আর রাফসান।আমি রায়ানা আর রাফসান কে কোলে নিয়ে বসে রইলাম।রায়না বয়স এখন ৮ মাস আর রাফসানের ৩ বছর।ছেলেটাকে প্রথম দেখেই মায়ায় পড়ে যাই।একদম আমার কোলে এসে যে বসেছে আর উঠছে না।রায়ানার সাথে মাঝে মাঝে খেলাও করতেছে।কি অপরুপ দৃশ্য।আমি শুধু বাসর ঘরে বসে ভাবতে লাগলাম।অরন্য কি আমার মত করে আমার মেয়েকে মানতে পারবে?এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম অরন্য এসেছে অরন্য আসার পর আমি উঠতে নিলে সে বলল


-আরে বাচ্চা নিয়ে উঠতে হবে না।দুই বাচ্চার জননী বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে স্বামীকেও একটু সময় দিয়েন।আপনি তো আমার পরিবারের বস ভুল হলে ক্ষমা করে দিয়েন।


আমি হাসিমাখা মুখে বললাম


-স্যার কি যে বলেন না।


অরন্য আমার মুখটা চেপে দিয়ে বলল


-সুন্দর একটা নাম আছে আমার ঐ নামেই ডাক।


আমি বেশ লজ্জা পেলাম।


সেদিনের পর থেকে আর কোন কষ্ট পাই নি।সত্যিই অরন্য তার কথা রেখেছিল।আমাকে কখনও কষ্ট দেয় নি।রায়ানা কে নিজের মেয়ের মত আদর করেছে।কেউ বলতে পারবে না যে রায়ানা অরন্যের সন্তান না।যে জায়গায় ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছি সে জায়গায় অরন্য আমাকে সাহস জুগাত।রায়ানা আর রাফসান কে নিয়ে আমার সুখের একটা সংসার হল।অফিসের কাজটা ছেড়ে দিয়ে আবার গৃহিনী পেশায় নিয়োজিত হলাম।


ছেলে মেয়েগুলা বড় হতে লাগল।সাথে আমার স্বামীর ভলোবাসা।সব মিলিয়ে বেশ অনেকটা বছর কেটে গেল।অনেকটা বছর বলতে ২৫ টা বছর কেটে গেল।আমি আর অরন্য অনেকটা পথ পারি দিয়ে আজ শেষ বয়সে পদার্পণ করেছি।তবে আমাদের ভালোবাসাটা একদমেই কমে নি।বয়স বাড়লেও মনের বয়সটা সেই যৌবনের ভালোবাসায় আটকে রয়েছে।এর মধ্যে রাফসান ডাক্তার হয়ে বের হল।আর রায়নাও এডভোকেট হয়ে বের হল।


রাফসানের বিয়ের কথা ভাবছিলাম।কিন্তু রাফসানের জন্য বিয়ের পাত্রী দেখার কোন ঝামেলা হল না।ছেলেটা লাজুক হলেও তার জীবন সঙ্গী পছন্দ করে রেখেছিল।মেয়েটার নাম আনিয়া।আনিয়াকে দেখে আমাদের ও পছন্দ হয়।মেয়েটা বেশ মিষ্টি স্বভাবের।আনিয়ার বাড়ি গিয়ে রাফসানের বিয়ে ঠিক করে আসি।আনিয়ার পরিবার দ্বিমত করে নি।১ মাস পরেই বিয়ের দিন ধার্য করা হল।


সেদিন আমি আর অরন্য, আনিয়া আর রাফসানকে আর রায়ানা নিয়ে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে গেলাম।বরাবেরর মত আমার একটা অভ্যাস হল গাড়ি থেকে নেমেই আশে পাশের অসহায় মানুষগুলোকে একটু সাহায্য করি।একটা সময় নিজে সাহায্য পায় নি তাই এ অসহায় মানুষের আর্তনাদ বুঝি।


তাই সবসময় এর মত আমি গাড়ি থেকে নেমেই তাদের কাছে গিয়ে সামান্য অর্থ দিতে লাগলাম।হুট করে চোখ আটকে গেল একটা চেনা মুখে।বেশ চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। ভালো করে খেয়াল করলাম লোকটার পা নাই আর ভিক্ষা করছে।লোকটাকে আরেকটু ভালো করে দেখার পর চিনতে পারলাম।এ আর কেউ না এ রাজিব। রাজিবের এ দশা দেখে অনেক বিস্মিত হলাম।রাজিবের কাছে গেলাম।রাজিব আমাকে দেখতেই চিনে ফেলেছে।যদিও বয়স হয়েছে চামড়া কুচকে গিয়েছে তবুও দুজন দুজনকে চিনতে ভুল করে নি।


রাজিব আমাকে দেখেই আমার পায়ে ধরে বলতে লাগল


-তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি শান্তি পায় নি সাদিয়া।আমাকে ক্ষমা করে দিও। লিরাকে বিয়ের পর সমস্ত সম্পত্তি লিরাকে লিখে দিয়েছিলাম।ভালোই চলছিল সংসার।বিয়ের ২ বছর পর আমার এক্সিডেন্টে পা টা চলে যায় সে সাথে চলে যায় বাবা হওয়ার ক্ষমতা।আর লিরা আমার সাথে প্রতরণা করে সম্পত্তি নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়।আমি লিরাকে হারিয়ে আর পিতৃত্ব হারিয়ে বুঝেছিলাম তোমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছি।


এ বলে রাজিব আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগল।দূর থেকে অরন্য বলল


-কি হল সাদিয়া দেড়ি করছ কেন?


আমি একটা মুচকি হেসে বললাম


-লোকটা অনেক অসহায় তাই পায়ে ধরে ভিক্ষা চাচ্ছে।তুমি রায়ানাকে দিয়ে ৫০০ টাকা পাঠাও তো।


অরন্য আমার কথা মত রায়ানা দিয়ে ৫০০ টাকা পাঠাল।আমি রায়ানাকে বললাম


- রায়ানা আঙ্কেল টাকে ৫০০ টাকা দিয়ে দোআ চাও।


রায়ানা আামর কথা মত রাজিবকে ৫০০ টাকা দিয়ে বলল


-চাচা আমার মা আর বাবার জন্য দোআ করবেন।


রাজিব ৫০০ টাকা নিয়ে অজোরে জল ফেলতে লাগল।


আহ কি সুন্দর আল্লাহর বিচার।আল্লাহ সবসময় সঠিক বিচার করেন তা না হলে আজকে মেয়ের কাছ থেকে বাবা ভিক্ষা নিচ্ছে আর মেয়ে চাচা বলে সম্বোধন করছে।হাহাহা আল্লাহ যে সবকিছু ফিরিয়ে দেয় এটাই তার প্রমাণ।আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।সবাইকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দেয়।


আমি রায়ানাকে বললাম এবার তুমি যাও আমি আসতেছি।রায়ানা বলল


-মা তাড়াতাড়ি আস। বাবা কিন্তু অপেক্ষা করছে।


এ বলে রায়ানা চলে গেল।আমি রাজিবের দিকে তাকিয়ে বললাম


-যে মেয়েকে অস্বীকার করে বের করে দিয়েছিলে সে মেয়ের হাতে ভিক্ষা নিতে কেমন লেগেছে রাজিব?


রাজিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল


-ৃ্মানে


জাবাবে আমি বললাম


-তৃনার বাচ্চা রায়ানা।আর ঐযে লোকটা দেখছ সে আমার দ্বিতীয় স্বামী।আমিও দ্বিতীয় বিবাহ করেছি তবে আমি সুখে আছি।কিন্তু তুমি তো ঠকিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলে তাই তোমার জীবনের এ হাল।এই আকাশটা দেখছ সেখানে একজন ছিল সেটা ভুলে গিয়েছিলে তখন আজকে আাকাশের দিকে তাকাও আর পারলে উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও।আর এ ৫০০ টাকাও রাখ, কিছু খেয়ে নিও।


এ বলে মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলাম।


অরন্যের হাতটা ধরে শপিং এ ঢুকলাম।আর ভাবতে লাগলাম জীবনে কোন অপরাধ না করলে ঠিকেই স্বস্তি
মিলে।আমিও স্বস্তি পেয়েছি।হয়ত কিছুদিন কষ্ট করেছিলাম।তবে সেটা আমার পরীক্ষা ছিল।হতাশ না হয়ে আল্লাহকে ভরসা করেছিলাম বলে এরকম একটা মানুষের হাত ধরে এখনও হাঁটতে পারছি।


সেদিন শপিং করে এসে অতীতের কথা ভেবে মুচকি হেসে আলহামদুলিল্লাহ বললাম।আর বললাম যা হয় ভালোর জন্য হয় এটা প্রমাণিত।


এর মধ্যে রাফসানের বিয়েটা সম্পন্ন হল।দেখতে দেখতে আরও একটা বছর কেটে গেল।রায়ানার জন্য ও পাত্র দেখা হল।রায়ানার বিয়ে ও ঠিক হল।রায়ানা বিয়ের আগে বায়না করে বসল বৃদ্ধাশ্রমে খাওয়াবে।আমিও অমত করলাম না।দিনক্ষণ ঠিক করে চলে গেলাম বৃদ্ধাশ্রমে।


সেখানেও প্রথম চোখ গেল আমার একটা মহিলার উপর চিনতে আর বাকি রইল না এ মহিলা কে।এ মহিলাটায় লিরা।যার জন্য রাজিব এত কিছুর আয়োজন করেছিল।আমি রায়ানা ডাক দিয়ে বললাম


-মা রায়ানা তোমার ঐ আন্টিটাকে জিজ্ঞেস কর এ বৃ্দ্ধাশ্রমে কে পাঠিয়েছে।উনাকে দেখে মায়া লাগছে।


রায়ানা গিয়ে লিরাকে জিজ্ঞেস করল


-আন্টি এখানে কে পাঠিয়েছে?আপনার কি ছেলে মেয়ে নাই।


লিরা চোখ মুছতে মুছতে বলল


-এক ছেলে আছে।স্বামী মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি নিজের করে নিয়ে আমাকে বের করে দিয়েছে মা।


দূর থেকে কাহিনী শুনে লিরার কাছে গেলাম।রায়ানকে বললাম


-বিরিয়ানির একটা প্যাকেট আমার হাতে দাও আর বাকিগুলো অন্যদের দিতে থাক।


রায়ানা তাই করল।আমি বিরিয়ানির প্যাকেটটা লিরাকে দিয়ে বললাম


-ভোগের জিনিস কখনও কপালে সয় না।আল্লাহ সব কেড়ে নেয়।


কথাটা শুনে লিরা চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকাল।হয়ত লিরা আমাকে চিনেছে হয়ত চিনে নি।আমি মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলাম।


সেদিন বাসায় এসে এটাই ভাবতে লাগলাম আমি তো সুখ পেয়ে ওদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভুলে গেলেও আমার আল্লাহ ভুলে নি।আমার আল্লাহ ঠিকেই তাদের সঠিক শাস্তি দিয়েছেন।কথায় আছে আল্লাহ যা করে ভলোর জন্য।


আবারও মুচকি হেসে আকাশের দিকে তাকালাম।আমার স্বামী আমার পাশে এসে বলল


-কি গো গিন্নি এত খুশি যে।


আমি অরন্যের বুকে মাথা রেখে বললাম সত্যি বলতে জীবনে কিছু না হারিয়ে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া যে তুমি।


অরন্য আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল


-আমার জীবনের শেষ ভালোবাসাও তুমি।তোমাকে পেয়েও আমি ধন্য।মৃত্যুর পর ও তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই।


মনে মনে ভাবলাম এক দ্বিতীয় বিবাহ আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে আর আরেক দ্বিতীয় বিবাহ আমার জীবনটাকে গড়ে দিয়ে একটা সুন্দর সম্পর্কে আবদ্ধ করেছে।


আর যারা ঠকিয়েছে তারা শাস্তি পেয়েছে।একজন পা হারিয়ে মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা চাচ্ছে আরেকজন সন্তান থাকা সত্ত্বও বৃদ্ধাশ্রমে শূন্যতায় জীবন কাটাচ্ছে।


আর আমি স্বামীর ভালোবাসায় পরম আনন্দে জীবন কাটাচ্ছি।


ওহ আর ঐ যে সেতারার প্রমিক ছিল সে সেতারার শোকে পাগল হয়ে পাগলা গারদে আছে। আমি আর অরন্য এখনও মাঝে মাঝে তাকে দেখতে যাই।সত্যিই সব ছেলেরা এক হয় না।কিছু কিছু ছেলেও পাগলের মত ভালোবাসতে জানে।


কেটে গেল আরও কয়েকটা বছর।এখন একটু বয়সটা বেড়েছে, প্রেসারটা বেড়েছে তবে দুই ছেলে মেয়ের পরম যত্নে অরন্য আর আমি বেশ ভালো আছি।


(গল্পটা থেকে এটাই শিখতে পারি যে জীবনের চলার পথে অনেক বাঁধা আসবে তবে উপর আল্লাহর উপর ভরসা করে সামনের দিকে এগিয়ে চললে অবশ্যই আলোর দিশা পাওয়া সম্ভব।কখনও এটা ভাাবা উচিত না যে আমি দোষ করে নি আল্লাহ আমায় শাস্তি দিচ্ছে আর যে দোষ করেছে তাকে শান্তিতে রাখছে।এরকম ভাবলে বলব আপনি গোড়ায় গলদ করেছেন।কারন আল্লাহ আপনাকে কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা নেয়।যদি আপনি সৎ থাকেন অবশ্যই আপনার সুদিন আসবে আর যে অন্যায় করেছে সে দুনিয়াতে শাস্তি না পেলেও আখিরাতে পাবে।মনে রাখবেন আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।প্রত্যেকটা কৃতকর্মের হিসাব নিবে।এটাও শিখতে পারি সব দ্বিতীয় বিয়ে জীবন ধ্বংস করে না।কিছু কিছু দ্বিতীয় বিয়ে জীবনটাকে একটা সুন্দর সম্পর্কে আবদ্ধ করে)


দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্ক

লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা।

👉👉 সমাপ্ত  👈👈





No comments

Powered by Blogger.

আসুন করনা সম্পর্কে সচেতন হই সুস্থ থাকি ।