গল্প : হৃদয়ের দহন
গল্প : হৃদয়ের দহন ♥
লেখিকা : Mst Shefa Moni
বধূর সাজে তেরো বছরের ছোট্ট বালিকাটি মাথায় বড় একটি ঘোমটা দিয়ে বসে আছে! ভয়ে সে নড়াচড়া করার মতো শক্তি টুকুও হারিয়ে ফেলেছে!
কিছুক্ষণ পর বরের বেশে সানভী রুমে প্রবেশ করলো। সে রুমের দরজা লক করতেই দেখলো মেয়েটি ঈষৎ কেঁপে উঠল। সে ধীর পায়ে বিছানার এক কোনায় গিয়ে বসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো-
--"নাম কি তোমার?"
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
--"জ্বি নীলা!"
সানভী বুঝতে পারলো নীলা ওকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। তাই সে নীলার ভয় দূর করার জন্য বললো-
--"মাথায় এতো বড় একটা ঘোমটা টেনে রেখেছো কেনো? লজ্জায়?"
নীলা আগের মতোই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
--"জ্বি না!"
--"তাহলে এমন জড়সড় হয়ে মাথায় ইয়া বড় একটা ঘোমটা টেনে বসে আছো কেনো? নরমাল ড্রেস পরে নাও!
নীলা তবু আগের মতোই বিছানার এক পার্শ্বে গুটিশুটি মেরে বসে রইলো।
নীলার আচরনে এবার সানভীর কিছুটা হাসি পেলো। কিন্তু সে হাসি চেপে রেখে বললো-
--"ভয় নেই! আমি তোমায় স্পর্শ করবোনা! তুমি নির্দ্বিধায় ড্রেস চেঞ্জ করে এসে ঘুমুতে পারো!"
সানভীর কথায় যেনো নীলা প্রান ফিরে পেলো! সে গুটি গুটি পায়ে ওয়াশ রুমে গেলো ড্রেস চেঞ্জ করতে। আর সানভী পাগড়ী টা খুলে রেখে বিছানার এক পার্শ্বে শুয়ে পরলো!
নীলার মা বহুদিন ধরে সানভীদের বাসায় কাজ করতেন! উনি খুব সৎ আর কর্মঠ মহিলা ছিলেন! এজন্য সানভীর মা সাহানা বেগম ওনাকে অনেক ভালোবাসতেন। নীলা মাঝে মাঝেই ওর মায়ের সাথে এসে এটা ওটা কাজ করতো!
খুব অল্প বয়স থেকেই নীলা প্রতেকটা কাজ নিখুঁত ভাবে করতে পারতো। যেটা সানভীর মাকে সবসময় মুগ্ধ করতো!
সব ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎই আজ সকালে খবর আসলো নীলার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছে। সাহানা বেগম তার পরিবারের সকলকে নিয়ে নীলার মায়ের দাফন কাফনের কাজ সম্পন্ন করলেন।
শেষে চোখ পরলো নীলার উপরে! এই পৃথিবীতে নীলার আপনজন বলতে ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। সাহানা বেগম অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তার একমাত্র সন্তান সানভীর সাথে নীলাকে বিয়ে করিয়ে দিবেন! তারপর নিজের পুত্রবধূ করে সারাজীবন নিজের কাজেই রাখবেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। সানভী প্রথমে অনেক আপত্তি করলেও পরে মায়ের মন রক্ষার্থে রাজি না হয়ে আর পারলোনা। কারন কাজের মহিলার মেয়েকে বিয়ে করাটা, সে খুব সহজে মেনে নিতে পারছিলো না! যদিও তার কোথাও কোন মেয়ের সাথে রিলেশন নেই তবুও!
নীলা থ্রি পিচ পরে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। সানভী একবারো নীলার দিকে তাকালো না পর্যন্ত! এমনকি কোন কথাও বললো না! আর তাতেই নীলা বেশি কমফোর্ট ফিল করলো। সে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো!
তাদের মধ্যে আর কোন কথা হলো না! কিছুক্ষন পর দুইজন দুইদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পরলো।
পরদিন সকালে নীলার ডাকে সানভীর ঘুম ভাঙলো। সে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো নীলা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখ ডলতে ডলতে সানভী বিছানা থেকে উঠে পরলো। সে এই প্রথমবার নীলাকে খুব কাছ থেকে ভালো ভাবে দেখলো।
নীলার মাথায় ঘাড় পর্যন্ত ছোট ছোট চুল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের বরণ। মুখ ভর্তি ছোট ছোট দাগ! শরীর টা ভীষণ শুকনো! চোখ গুলোও বসে গেছে! চেহারায় সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই। সানভীর বিরক্তি যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো!
শুধু মায়ের মন রক্ষার্থে নীলার সাথে কোন উল্টা পাল্টা আচরন করতে পারছে না। কিন্ত সবসময়ই নীলার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলছে!
নীলাকে কোন দিক থেকেই সানভীর সাথে মানায় না। সানভী বিশাল ঢণাঢ্য বাবা মার একমাত্র সন্তান। যেমন ট্যালেন্ট স্টুডেন্ট তেমনি সুন্দর দেখতে। ছয় ফিট লম্বা। কাঁচা স্বর্নের মতো গায়ের বরণ! ছিপছিপে শরীর। চোখ দুটো ভাসা ভাসা। ভরাট ঠোঁট। ধনুকের মতো জোর ভ্রু আর তীক্ষ্ম নাকে তার সৌন্দর্য যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
সানভী ভিষন ম্যাচিউর একটা ছেলে। সে নীলার সাথে খুব নরমার ভাবে মিশতে লাগলো। যাতে ফ্যামিলির কেউ ওর আচরন দেখে বুঝতে না পারে যে নীলাকে তার পছন্দ নয়। কিন্তু নীলার বয়স অল্প হলেও সে ঠিকই আঁচ করতে পারলো সানভী ওকে পছন্দ করে না। তবে নীলার তাতে কিছু যায় আসে না। কারন সে দুবেলা দুমুঠো খেতে পরতে পারলেই মহাখুশি। তাছারা সানভীর মাও তাকে অনেক ভালোবাসে! এটাই তার কাছে অনেক। এর চেয়ে আর বেশি কিছু সে চায়না! আশাও করেনা!
এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেলো। সানভী মাস্টার্স কমপ্লিট করার জন্য লন্ডনে চলে গেলো!
তিন বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন সানভী দেশে ফিরতে চাচ্ছিলো না, তখন ফ্যামিলির সবাই বুঝতে পারলো, ওর সমস্যা টা কোথায়! তার উপরে আবার লন্ডন যাওয়ার পর থেকে সানভী কখনো নীলার সাথে কথা বলেনি!
নীলা এই তিন বছরে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে! অনেকটা বড়ও হয়ে গেছে! সে আর আগের মতো নেই। অনেক সুন্দরীও হয়ে গেছে! কোমড় অব্দি ছড়ানো সোনালি চুল, দুধে আলতা গায়ের বরন, ঘন কালো ভ্রু! হরিনীর মতো টানা দুই চোখের ঢলঢল চাহনী, দীর্ঘাকৃতির হালকা পাতলা শরীর, যেনো সদ্য ফোটা ফুলের মতো নগ্ন রুপসী। ছুঁয়ে দিলেই মুড়ে যাবে!
নীলা যখন বুঝতে পারলো সানভী ওর জন্যেই বাসাতে আসছে না, তখন সে বাধ্য হয়ে সানভীকে ডিভোর্স দিতে চাইলো! কিন্তু সানভীর মা সাহানা বেগম কিছুতেই সেটা মেনে নিতে চাইলেন না। তিনি নীলাকে ওনার মায়ের বাসায় রেখে আসলেন। ওনার মা অনেক বয়স্ক মহিলা। তাকে দেখাশুনা করার জন্য একটা মেয়ে রাখা ছিলো। তিনি সেই মেয়েকে বাদ দিয়ে নীলাকে তার মায়ের দেখাশোনা করার জন্য রাখলেন। যাতে একি সাথে দুই কাজ হয়ে যায়।
নীলার বাসা থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনে কয়েকদিন পরই সানভী দেশে ফিরে আসলো। এসেই সে নীলাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলো। আর অবশেষে পেয়েও গেলো! সে ওর মাকে জানালো, যদি ওনারা নীলাকে ডিভোর্স দিতে না দেয়, তাহলে সে লন্ডনে গিয়ে আর কখনো দেশে ফিরবে না!
শেষে অনেক ভেবে চিন্তে সাহানা বেগম তার ছেলেকে বললেন-
--"নীলাকে ডিভোর্স দেওয়ার দরকার নেই। সে কখনো তোর সামনে এমন কি এই বাসাতেও আসবে না! চলবে?" সানভী তবু ডিভোর্সের বিষয়টার জন্য সে মুখ ভার করে বসে রইলো!
সাহানা বেগম সেটা বুঝতে পেরে বললেন-
--"তুই যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাস তাহলে করতে পারিস! এতে নীলার কোন আপত্তি নেই! তবে সে বেচারী অনাথ মেয়ে। ডিভোর্সের কথা শুনে যদি কোন অঘটন ঘটায় সেই ভার কে নেবে?"
সানভী তবু চুপ করে রইলো! সাহানা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
--"সে কখনো তোর কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবেনা। অমন মেয়ে সে নয়! এতটুকু আস্থা রাখতে পারিস!"
সানভী নাছোড় বান্দা। সে কোনভাবেই তার মায়ের কথাতে সায় দিলোনা!
এতে সাহানা বেগম মনে মনে অনেক কষ্ট পেলেন! তবে সেটা সানভীকে বুঝতে দিলেন না। কারন তিনি নীলাকে সারাজীবনের জন্য পুত্রবধূ করে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের অটল সিদ্ধান্তে তিনি হার মেনে গেলেন।
কয়েকদিন পরই নীলার কাছে এক দুঃসংবাদ আসলো! সানভী ওকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে! সে প্রথমে কিছুটা কষ্ট পেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। সানভীর দেওয়া অবহেলা সহ্য করতে করতে সে এখন অনেক বড় বড় কষ্টও হজম করতে শিখে গেছে!
নীলা ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে সানভীদের বাসায় রওনা দিলো! কারন সে আজ সানভীকে অনেক কিছু বলতে চায়। যেগুলো সে তিনটা বছর ধরে মনের মধ্যে জমা করে রেখেছে!
সানভী বাইকটা স্টার্ট করে লুকিং গ্লাসে তাকাতেই দেখলো এক পরমা সুন্দরী মেয়ে মাথা নিচু করে তাদের বাসায় প্রবেশ করছে! পরনে তার হালকা আসমানী রংয়ের একটা শাড়ি। মাথায় আঁচল তুলে দেওয়া। হাতে একটা সাদা কাগজ। মেয়েটিকে যতক্ষণ পর্যন্ত লুকিং গ্লাসে দেখা যায় সানভী ততক্ষণ পর্যন্তই তাকিয়ে দেখলো।
তবে মেয়েটিকে যে সে এতো নিখুঁত ভাবে দেখছে সেটা কিন্তু সে বুঝতে পারছেনা। কারন সে এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
মেয়েটি যখন একদম সানভীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো তখন সানভী ইচ্ছা করেই জোরে একটা হর্ন দিলো। আর অমনি মেয়েটির হাত থেকে কাগজটি পরে গেলো! সে যখনি নিচু হয়ে কাগজটি উঠাতে গেলো তখন তার মাথা থেকে আঁচল পরে গেলো! আর সানভী চোখ ভরে তাকে দেখে নিলো! সে এমন অপরুপা সুন্দরী মেয়েকে আগে কখনো দেখেনি!
মেয়েটি কাগজ তুলে নিয়ে আবার মাথা নিচু করে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। কিন্তু কয়েক পা এগুতেই সে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে ঘুরে সানভীর দিকে তাকালো! খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়েই আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো! মেয়েটির অমন তীক্ষ্ম চাহনিতেও সানভীর নেশা ধরে গেলো! সে পুরোই ক্রাশ খেয়ে গেলো!
সানভীর ইচ্ছে করছিলো কোর্টে না গিয়ে মেয়েটির পিছু পিছু বাসায় প্রবেশ করতে। কিন্ত তাতে মেয়েটির কাছে তার ওয়েট কমে যাবে ভেবে সোজা কোর্টের অভিমুখে রওনা দিলো!
সাহানা বেগম তখন ডাইনিং রুমের সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন। এমন সময় নীলাকে দেখে উনি যেনো আকাশ থেকে পরলেন। নীলা ওনার অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরে বললো-
--"ভয় পেওনা বড়মা! আজ আমি কোন আবদার নিয়ে আসিনি! শুধু ওনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি!"
সাহানা বেগম নীলার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন! কয়েক সেকেন্ড পর আমতা আমতা করে বললেন-
--"আমি খুব করে চেয়েছিলাম মা, সারাজীবন তোকে নিজের কাছে আগলে রাখতে! কিন্তু সে তো খাঁটি সোনা চিনতে জানলো না!"
নীলা কোন কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো। সাহানা বেগম সানভীকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বললেন।
মায়ের ফোন পেয়েই সাথে সাথে সে বাসায় রওনা দিলো। যদি বাসায় গিয়ে ঐ মেয়েটিকে আবার দেখতে পায় সেই আশায়!
কিছুক্ষণ পর সানভী বাসায় আসলো। এবং তার মনোবাসনাও পূর্ণ হলো। সে মেয়েটিকে সোফায় বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলো। মেয়েটিকে দেখা মাত্রই তার মনে ব্যান্ড বাজতে লাগলো! যদি কোন ভাবে পটিয়ে পাটিয়ে নেওয়া যায় মনে মনে তার ছক কষতে লাগলো!
--"সানভী বউমা তোর সাথে কিছু কথা বলতে এসেছে!"
সাহানা বেগমের কথায় সানভীর চমক ফিরলো! সে আশ্চর্যের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়ে বললো-
--"বউমা?"
সানভীর মুখে বউমা কথা শুনে সাহানা বেগম ভাবলেন হয়তো বউমা বলাতে সে রাগ করেছে! তাই তিনি বিষয়টা সহয করার জন্য বললেন-
--"নীলা তোর সাথে কিছু কথা বলতে এসেছে!"
সানভীর কাছে এতোক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো। সে বুঝতে পারলো এই মেয়েটায় তার স্ত্রী ছিলো! কিন্তু সে অবাক হয়ে গেলো এই ভেবে যে সেদিনের সেই ছোট্ট বালিকাটি আজ এতো বড় হয়ে গেছে। এতো রুপসী হয়ে গেছে!!
কতোটা অবহেলায় আর অযত্নে তার বাল্যকাল কেটেছিলো যে অমন চাঁদের মতো সুন্দর মুখ খানি কালো মেঘের আবরণে ঢেকে গিয়েছিলো। সানভী মনে মনে বেশ অনুতপ্ত হলো!
নীলাকে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যেতে দেখে সানভীর ভ্রম কেটে গেলো। সে নীলার পিছু পিছু ছাদে উঠতে লাগলো!
এদিকে নীলার ভেতরে দ্বিধা দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। সে কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে মনে মনে সেসব আউরে নিতে লাগলো! সে ছাদের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো! সানভীও ধীর পায়ে ওর পিছু পিছু গিয়ে ওর থেকে সামান্য দূরে গিয়ে দদাঁড়ালো। সানভীর ভেতরেও খুব অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। কারন সে প্রতিটা পদে পদে বুঝতে পারছে সে নীলাকে কতোটা অবহেলা করেছে!
নীলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলতে শুরু করলো-
--"আসলে আমি তো আপনার মতো অতো বেশি পড়াশোনা করিনি! তাই বুঝতে পারছিনা কোনটা বলা ঠিক হবে আর কোনটা বলা ভুল হবে। তবে আপনি তো অনেক শিক্ষিত মানুষ। আমার ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন!"
সানভী কোন কথা বললো না। শুধু চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো!
নীলা সানভীর দিকে তাকিয়ে বললো-
--"আমি খুব গরীব ঘরের মেয়ে আর দেখতে অসুন্দর বলে আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাতে আমার কোন রাগ নেই। কারন আপনাকে পাওয়ার মতো যোগ্যতা সত্যিই আমার নেই। কিন্ত আপনি কি চাইলে আমার উপর একটু সহানুভূতিশীল হতে পারতেন না? আপনাদের বাসায় খেয়ে পরে কতো কুকুর বেড়াল বড় হচ্ছে। আমি তো সেভাবেই দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে থাকতাম। কখনো ভুল করেও আপনার কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে যেতাম না! যে মেয়েটার নিজের বলতে কিছুই নেই তার কাছে আপনার এতো কিসের অহংকার? অহংকার তো তার সামনে করা সাজে, যার কাছে অহংকার করলে পাল্টা তারও অহংকার দেখানোর সামর্থ্য থাকে!"
শেষ কথা গুলো বলতে গিয়ে নীলার কন্ঠ আটকে যেতে লাগলো। ঠিক কান্নার পূর্ব মহুর্তে যেমন সবার কন্ঠ আটকে যেতে লাগে তেমন।
সানভী লজ্জায় কোন কথা বলতে পারলোনা! কিন্তু তবু অহংকারের ভারে জর্জরিত হয়ে নীলার কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে রাখলো!
নীলা এবার সানভীর দিকে না তাকিয়েই বললো-
--"অনেক কিছু বলার ছিলো! কিন্তু থাক! যেখানে কোন সম্পর্ক নেই সেখানে যতো কম কথা বলা যায় ততোই ভালো! আমি ডিভোর্স পেপারে সাক্ষর করে এনেছি।"
কথাটা বলেই সে কাঁপা কাঁপা হাতে সানভীর দিকে কাগজ টা এগিয়ে দিলো। সানভীর মন চাচ্ছিলো কাগজ টা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। নীলাকে চিৎকার করে বলতে, যে সে এই ডিভোর্স মানেনা। সে যা করেছে তা সব ভুল করেছে! কিন্তু না! সে কিছুই বলতে পারলো না ! তার অহংকারের জোরে। ইগোর জোরে।
--"কাগজ টা নিন!"
সানভী হাত বাড়িয়ে কাগজ টা নেওয়ার সময় একপলক নীলার দিকে তাকালো। সে দেখলো নীলার চোখ রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে আছে! চোখ ভর্তি পানি টলমল করছে!
নীলা ভেবেছিলো সানভী হয়তো ওকে দেখে সবকিছু ভুলে যাবে। আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে! কিন্তু না। সানভীর মুখে অনুতপ্তের ছাপ ফুটে উঠলেও মুখ ফুটে তা বের হলো না।
সানভী বুঝতে পারছে, নীলা ওকে এখনো চায়! কিন্তু সে নিজের ইগো আর অহংকারের জোরে একটা সরি বলার সাহস টুকুও পাচ্ছে না!
সানভীকে চুপ থাকতে দেখে নীলা নিজ থেকে আর কোন কথা না বলে চলে যেতে লাগলো! কিন্তু কয়েক পা ফেলতেই সে থেমে গেলো! নীলাকে থেমে যেতে দেখে সানভীর বুকে যেনো আশার সঞ্চার হলো। সে মনে মনে চাইলো নীলা ঘুরে এসে ওকে বলুক, সে ডিভোর্স দিতে রাজি না। তারপর সানভী আর কোন ঝামেলা করবেনা। সাথে সাথে ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে!
সানভী মনে মনে এই সব জল্পনা কল্পনা করতেই দেখলো নীলা ওর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে! ওর চোখে পানি টলমল করছে! একটু ছোঁয়া পেলেই যেনো শ্রাবণের মেঘধারার মতো ঝরে পরবে!
নীলা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
--"আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?"
কথাটা বলার সাথে সাথেই নীলার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো। সানভী একটু এগিয়ে যেতেই নীলা ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
--"আমি ভেবেছিলাম আমার চেহারা খারাপ ছিলো জন্য আপনি আমায় পছন্দ করেন না। স্ত্রী হিসেবে মানেন না। সে জন্য আমি কতো যত্নে নিজেকে একটু একটু করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছি! কিন্তু না! আমার ধারনা ভুল ছিলো! আমি আপনার যোগ্যই না!"
এবার সানভীর মুখ ফুটলো। সে ধীর গলায় বললো-
--"এসব নিয়ে কথা বাড়িয়ে আমায় আর ছোট করিওনা প্লিজ!"
নীলা সানভীর গলা থেকে এক হাত নামিয়ে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো-
--"আপনি জানের আমি আপনার কথা রোজ কতোবার ভাবতাম?"
--"কতোবার?"
--"যতোবার আমি নিঃশ্বাস নিতাম ঠিক ততোবার! কিন্তু আফসোস্! সেই তিন বছরের মধ্যে আপনার হাতে এক সেকেন্ডও সময় হয়নি আমার জন্য!"
কথাটা বলেই সে সানভীকে ছেড়ে দিলো। সানভী মনে মনে অবাক হয়ে গেলো। যে মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন ইগনোর করে গেছে সেই মেয়েই কিনা তাকে দিনের পর দিন একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছে! নিজেকে সে অনেক ভাগ্যবান মনে করলো! কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।
এটাই সানভীর বড় প্রবলেম। আত্ম-অহংকারে একদম গাছের মগডালে উঠে বসে থাকবে! মুখ ফুঠে কিছু বলবেনা। কিন্তু ভেতর ভেতর কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাওয়ার জন্য কুঁড়ে কুঁড়ে মরবে! অস্বাভাবিক কোন আচরন করবেনা ঠিকই কিন্তু নিজের জেদ পুরন করতে গিয়ে অনেক দুঃসাধ্য কাজও সহয সাধ্যে করে ফেলবে!
তার এসব চুপচাপ নিরবতা নীলার কাছে ভীষন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। সে মহুর্তের মধ্যেই সানভীর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
--"ভয় নেই! আমি যদি গলে-পচে মাটির সাথে মিশেও যাই তবু কখনো আপনার কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবোনা! কক্ষনো না! ভালো থাকবেন!"
কথাটা বলেই সে খুব দ্রুত পায়ে চলে যেতে লাগলো! সানভীর উত্তরের অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য আজ তার শেষ হয়ে গেছে। নিচে যেতেই সাহানা বেগম নীলার হাতটা খপ করে ধরে বললেন-
--"তুই আমায় কথা দে মা! রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু করবিনা?"
নীলা কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
--"হুম! তুমি আমায় নিয়ে একদম চিন্তা করবে না বড় মা! দেখবে একদিন আমি ঠিকই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি!"
নীলা আর বিন্দু মাত্র দেরী না করে চলে যেতে লাগলো! সানভী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো নীলা খুব দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে! ওর মাথায় কোন কিছু কাজ করলো। সোজা রুমে গিয়ে সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলো!
নীলা ট্যাক্সি করে ওর বান্ধবী জেসিকার বাসায় চলে গেলো। জেসিকা ওর ছোট বেলার বান্ধবী। সে অনেক ধনী ঘরের মেয়ে। পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। নীলা ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বললো! সব শুনে সে একগাল হেসে বললো-
--"এ আবার কি সমস্যা! আমার সাথেই খাবি-দাবি, থাকবি! নো প্রবলেম! আর তোকে আমি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের সব কাজ শিখিয়ে দিবো। তুই তো হাতের কাজে অনেক এক্সপার্ট। খুব সহজেই সব কিছু আয়ত্ত করতে পারবি! সেলারিও অনেক বেশি!"
নীলা কৃতজ্ঞতায় মুখ লাল করে বললো-
--"আমি কখনোই ভাবিনি জেসি তুই আমায় এত্তো ভালোবাসিস! লাভ ইউ!"
--"হুম! পরে জানি আমায় আবার ভুলে যাসনা তাহলেই হবে!"
নীলা খুশিতে কান্না করে ফেললো! সে জেসিকাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
--"তোর এই উপকার আমি সারাজীবন মনে রাখবো!"
দুইদিন পরের ঘটনা! সানভী অলরেডি নীলার ঠিকানা কালেক্ট করে ফেলেছে! শুধু এতোটুকুই নয়! নীলার পেছনে ওর ফ্রেন্ড সিয়াম কে ডিটেক্টিভ হিসেবে লাগিয়ে রেখেছে। নীলা কখন কোথায় যায় কি করে সব কিছু সিয়াম ফলো করে ওকে বলে দেই। এই কাজের জন অবশ্য সিয়ামকে সে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে!
দুপুরে গোসল সেরে সানভী মাত্র খেতে বসেছে, এরই মধ্যে সিয়ামের ফোন আসলো! সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিয়াম বললো-
--"দোস্ত! ভাবীর সাথে যে মালটা আছে না! সে তো হেভি চাল জানে দেখছি! ভাবীকে নিয়ে শপিংমলে এসেছে। সাথে একটা ছেলেকেও এনেছে! তুই কি আসবি?"
--"লোকেশন অন কর আমি এখনি রওনা দিচ্ছি!"
সানভীর আর খাওয়া হলো না! সে হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে ড্রেস চেন্জ করেই রওনা দিলো! ওর মাথা এখন হ্যাং হয়ে গেছে!
নীলা আর জেসিকার সাথে যে ছেলেটি ছিলো সে মূলত মেয়েলি টাইপের। আই মিন থার্ড জেন্ডার যাকে বলে আরকি! সে জেসিকার এসিস্ট্যান্ট। সিয়াম ছেলেটাকে ভালোভাবে না দেখেই সানভীকে ঐসব বলে দিয়েছ! এখন জানার পর সে পরে গেছে মহাবিপদে। না জানি সানভী ওকে কি বলে!
নীলা ড্রেস চয়েস করতে করতে হঠাৎই খেয়াল করলো সানভী লিফট থেকে নেমে থার্ড ফ্লোরে আসছে। নীলারাও থার্ড ফ্লোরেই আছে। সানভীকে দেখেই সে থমকে দাঁড়ালো। সে ভাবতে লাগলো সানভী এখানে কি করতে আসছে!
সানভী ধূসর রঙের একটা শার্ট আর আর জিন্স প্যান্ট পরেছে। শার্টের বোতাম কয়েকটা খোলা রেখেছে! ভেতরের সাদা রঙের গেঞ্জিটা দেখা যাচ্ছে। চোখে সানগ্লাস। এক হাতে বাইকের চাবি আর এক হাতে ফোন!
কয়েক পা না যেতেই সানভীও নীলাকে দেখে ফেললো। নীলা বেগুনী রঙের একটা ওয়েটল্যাস শাড়ি পরেছে। নীলাকে খুঁজে নিতে ওর একটুও অসুবিধা হলোনা! খুব বেশি সময় ও লাগলো না!
সানভী দ্রুত পায়ে নীলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো তাদের সাথে কোন ছেলে নেই। যেটা আছে সেটা হাফ লেডিস! কিন্তু তবু সানভীর মাথায় চরচর করে রক্ত উঠতে লাগলো। সাথে সাথে ওর চোখে মুখে রাগের ছাপ ফুটে উঠলো। জেসিকা কি জানি বলতে চেয়েও বলার সাহস পেলো। সিয়াম শুধু ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলতে লাগলো।
সানভীর মাথায় রাগ উঠেছে নীলার পেটের কিছু অংশ বের হয়ে থাকতে দেখে! সে আড়চোখে নীলার পেটের দিকে কয়েকবার তাকালো! যাতে নীলা শাড়ি টা ঠিক করে নেয়। কিন্তু নীলা ওর চোখের ভাষা বুঝেও কোন কেয়ার করলো না! সে জেসিকাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যেতে লাগলো! এতে সানভী রাগের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো! সে নীলার বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো-
--"সমস্যা কি তোমার? ইদানীং খুব সাহস হয়েছে দেখছি! কান খুলে শুনে রাখো! এমন কিছু করো না যাতে আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়!"
সানভীর কথায় নীলা প্রচন্ড রেগে গেলো! সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-
--"আমায় নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন রাইট আপনার নেই। হাত ছাড়ুন!"
নীলার কথা শুনে সানভী রাগে আগুন হয়ে গেলো। সে নীলার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
--"আমায় কিন্তু বেশি রাগিয়ে দিওনা! না হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে!"
নীলা সানভীর চেয়েও দ্বিগুণ বেশি রেগে গেলো। সে এক ঝটকায় সানভীর হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা খুলে নিলো! সাথে সাথে এক হাত দিয়ে সানভির মাথার পেছনের চুলগুলো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো! তারপর তীক্ষ্ম চাহনিতে সানভীর চোখে চোখ রেখে বললো-
--"তোকে খুব বেশি রাগিয়ে দিলে তুই আমার কি করবে হ্যাঁ?"
সানভী কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নীলা ওর ঠোঁটে গভীরভাবে একটা কিস্ করলো।
সানভী তো চারদিকে একপলক তাকিয়ে পুরাই হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে নীলা বিন্দু মাত্র কাল বিলম্ব না করে জেসিকাকে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। সিয়াম ঢোক গিলতে গিলতে বললো-
--"এইটা কি হলো রে মামা? তোর ঠোঁটের তো পুরাই ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে গেলো!!!"
সানভী ওর হাত দিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। সিয়ামের সাথে কোন কথা বললো না!
নীলা বাসায় যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নিলো, সে কিছুদিনের মধ্যেই একটা ছেলের সাথে রিলেশন করে সানভীকে উচিত শিক্ষা দিবে! এদিকে সানভীও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে অন্য একটা মেয়ের সাথে টাইম পাস করে নীলাকে উচিত শিক্ষা দিবে!
সানভীর ধারনা সে নীলার রুপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে গেছে। তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছে। তাই সে প্রথমেই একটা সুন্দরী জিএফ খুঁজতে লাগলো! এবং খুব তাড়াতাড়ি পেয়েও গেলো! ওর ফুফাতো বোন রিশা। যেমন ধনীর দুলালী তেমনি হায়ার এডুকেটেড। দেখতে নীলার চেয়েও সুন্দরী! সানভীর মনের মধ্যে ব্যান্ড বাজতে লাগলো! কারন সে এবার নীলাকে আচ্ছা তরে শিক্ষা দিতে পারবে!
কিন্তু নীলা সেসবের কিছুই করলো। সে ভাবতে লাগলো সানভীর সাথে টক্কর দিতে যাওটা তার বোকামী হবে! এমনিতেই তার বয়স কম, তার উপরে আবার বাবা মা কেউ নেই। মাথার উপরে কোন ছাতা নেই! নিজের দেখভাল নিজেকেই করতে হয়! এতো সমস্যার মধ্যে সানভীর সাথে টক্কর দিতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার কি দরকার! বরং সে চুপচাপ নিরব হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো! সানভী যদি ওকে ভালোবাসে তাহলে ওর চুপচাপ নিরবতায় সানভীকে উচিত শিক্ষা দিবে!
জেসিকাদের বাসা রাজশাহীর কাজলাতে। রাজশাহী রেলওয়ের দিকে ওদের নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ আছে। নীলা সেখানে গিয়ে নিয়মিত কাজ শিখতে লাগলো। আর বাড়তি ঘুরাঘুরি একদম বন্ধ করে দিলো।
তাই সিয়ামেরও রুটিন মতোবেক ডিউটি পরে গেলো। রোজ কাজলা থেকে রেলগেট, রেলগেট থেকে কাজলা! বাড়তি কোন দৌড়াদৌড়ি নেই। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে সে!
কিন্তু সানভীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে লাগলো। কারন সে যে রিশার সাথে রিলেশন করছে সেটা নীলাকে সরাসরি দেখাতে পারছেনা! সেই অধৈর্যতা তাকে তিলে তিলে মারছে!
তবে সানভীকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলোনা!
জেসিকা তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করার জন্য নীলাকে সাথে করে নিয়ে গেলো নিউ মার্কেটের এক রেস্টুরেন্টে। ওর বয়ফ্রেন্ড তূর্য আগে থেকেই সেখানে বসে ওয়েট করছিলো। তাই সে রেস্টুরেন্টে গিয়েই তূর্যের সাথে আলাপচারিতা শুরু করে দিলো। আর নীলা চুপচাপ মাথা নিচু করে সেগুলো শুনতে লাগলো।
জেসিকার উচ্চতা খুব কম হওয়ায় তূর্যের ফ্যামিলি ওকে পুত্রবধূ হিসেব পছন্দ করেনি। যে কারনে তূর্য ওর সাথে ব্রেকাপ করেছিলো! কিন্তু এখন সে আবার জেসির কাছে ব্যাক করতে চায়।
জেসির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই কম। সাড়ে তিন ফিটের মতো। নীলার সাথে তার বন্ধুত্ব হওয়ার পেছনে অবশ্য এই কারনটা প্লাস পয়েন্ট বলা যেতে পারে।
নীলাদের বাসা ছিলো রাজশাহীর তালাইমারীতে। সেই সূত্রে দুজনের বাসা প্রায় পাশাপাশি হয়ে যায়। বিকেল করে রুয়েটের স্কুল চত্বরে নীলা অন্য সব ছোট বাচ্চাদের সাথে জড়ো হতো খেলাধুলার জন্য। আর জেসিকা সেখানে সবার নেতৃত্ব দিতো। যদিও সে তাদের সবার চেয়ে বয়সে সাত-আট বছরের মতো বড় ছিলো তবু উচ্চতায় সে তাদের কাতারে তাদের সমতুল্য হয়ে যেতো। তার আচরনেও কিছুটা শিশু সুলভতা ছিলো!
♥
প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পর নীলা সানভীর কন্ঠের মতো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তীক্ষ্ম চাহনিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো! কর্নারের দিকে চোখ পরতেই দেখলো সত্যি সত্যিই সানভী একটা মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে! মেয়েটাকে চিনতে ওর খুব বেশি সময় লাগলো না। কয়েক সেকেন্ড পরই সানভীর সাথে ওর চোখাচোখিও হয়ে গেলো!! কিন্তু সানভীকে তবু ভাবলেশহীন দেখালো!
দৃশ্যটা দেখার পর থেকে নীলার বুকের ভেতর মোচর দিতে লাগলো। মাথাটাও ঝিমঝিম করতে লাগলো। সে বাম হাতের উপর মাথাটার ভর দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো।
সানভী আড়চোখে নীলাকে প্রথম থেকেই দেখছিলো! সে নীলার এক্সপ্রেশন দেখে খুশি হওয়ার বদলে কিছুটা বিষন্ন হয়ে গেলো। কারন সে ভেবেছিলো নীলা ওকে দেখে হয়তো রেগে যাবে। কিন্তু না! সে নীলার মুখে কোন প্রকার রাগের ছাপ দেখতে পেলোনা। বরং তার চোখে মুখে এক প্রকার মর্মাহত হয়ে পরার ছাপ দেখতে পেলো!
সানভী আরো খেয়াল করলো নীলার চেহারায় আগের মতো আর সেই সৌন্দর্যটা নেই। এই কয়েক দিনেই মলিন হয়ে গেছে। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পরে গেছে। সানভীকে একধ্যানে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিশা বললো-
--"সানভী তুমি কি এখনো ঐ আন-কালচারাল ক্ষ্যাত মেয়েটার পিছে পরে আছো?"
রিশার কথা শুনে সানভীর চমক কেটে গেলো! সে নীলার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কিন্তু রিশার কথার কোন রেসপন্স করলোনা। এতে রিশা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো-
--"মামী নির্ঘাত সেকেলের মানুষ। তাই অমন নিচু ফ্যামিলির একটা মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের মতো ইয়ং জেনারেশনের ছেলে মেয়েরা কখনো ঐসব একসেপ্ট করবেনা! তুমি যেটা করেছো সেটা একদম ঠিক করেছো বেবি। এন্ড ইউ নো, আমি তোমায় ছোটবেলা থেকে কত্তোটা লাভ করি! আর ঐ ক্ষ্যাত মেয়েটার থেকে আমি সবদিক থেকে অনেক উচ্চে আছি! ইউ নো দ্যাট রাইট?"
সানভী এবারো রিশার কথার কোন রেসপন্স করলোনা। সে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো! ওর চোখের সামনেই এখন নীলার থেকেও সুন্দরী, হায়ার এডুকেটেড, ধনীর দুলালী মেয়ে রিশা বসে আছে! তবু সেদিকে ওর কোন মনোযোগ নেই। সে মেসেজে সিয়ামের সাথে চ্যাট করছে! সিয়াম নীলাদের পেছনের টেবিলে বসে আছে! নীলা কখন কি বলছে, তূর্য কতোবার নীলার দিকে তাকাচ্ছে এই সব কিছু সে সানভীকে মেসেজ করে বলছে! আর সানভী সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে!
কিছুক্ষণ পর তূর্য ওয়াশরুমে যেতেই সিয়াম আর সানভী ওর পিছে চলে গেলো। তূর্য ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই সানভী তূর্যের হাত ধরে বললো-
--"এই দেখি আপনার হাতটা দেখান!"
তূর্য অবাক হয়ে বললো-
--"কেনো ভাই কি হইছে? আমি কি করলাম?"
সিয়াম তূর্যের শার্টের কলার ধরে বললো-
--"ঐ ঢাকাইয়া মাল? আমগোর লগে ভেটকি করস? হাত দেখা কইতাচি!"
সানভী তূর্যের হাতের তালু দুই বার স্পর্শ করেই বললো-
--"ঐ ভাই আপনার হাত আঠা আঠা লাগে ক্যান?"
তূর্য ঘটনার আগা মাথা কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো প্রশ্ন করলো-
--"আরে ভাই কি হইছে সে টা তো বলবেন নাকি?"
সানভী সিয়ামকে রেগে গিয়ে বললো-
--"ঐ শালা তুই তো বলছিলি এই মালটা জেসির তাইলে কেমনে কি?"
--"হ মামা প্রথম তো দেখলাম জেসির সাথেই কথা বললো। মাগার শেষের দিকে গিয়া বার বার ভাবীর দিকে তাকাচ্ছিলো!"
সানভীর মাথা আরো গরম হয়ে গেলো। সে তূর্যের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
--"সুন্দরী মেয়ে দেখলেই কি জিভ দিয়ে লাল পরে? তোকে তো......
সানভীর কথা শেষ না হতেই সেখানে জেসিকা আর নীলা উপস্থিত হয়ে গেলো! সিয়াম তূর্যের শার্টের কলার ছেড়ে দিলো। জেসিকা কিছুটা রাগান্বিত হয়ে সানভীকে বললো-
--"সানভী কি হচ্ছে এসব? তোমাকে তো আমি অনেক ভদ্র একটা ছেলে ভাবতাম!"
তূর্য রেগে গিয়ে বললো-
--"এই ছেলেটা আমায় অনেক খারাপ কিছু ঈঙ্গিত করে কথা বললো! আমি তো কিছুই বুঝলাম না যে আমায় কেনো এসব বললো!"
নীলা তূর্যকে সরি বলে জেসিকাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো! সানভীর দিকে সে এক পলকের জন্যও তাকালো না!
সানভী তো রেগে আগুন হয়ে গেলো।
এরই মধ্যে সেখানে রিশা গিয়ে দাঁড়ালো। সানভীকে নাঁকি স্বরে বললো-
--"কি হয়েছে বেবি? হোয়াট হেপেন্ড?"
রিশার নাঁকি কন্ঠস্বর শুনে সানভী রাগে ফায়ার হয়ে বললো-
--"আমার মাথা হয়েছে! নাও হ্যাপি?"
রিশা রাগ করে চলে যেতে লাগলো। তবু সানভী ওকে কোন বাঁধা দিলো না। সিয়াম মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো-
--"মামা এখন তাহলে আমাদের নেক্সট প্ল্যান কি?"
--"নেক্সট প্ল্যান কি সেটা তো তোরই ভালো জানার কথা।"
--"ক্যান মামু?"
--"কারন আমার মাথাটা তুই অনেক আগেই খেয়ে ফেলছিস! তাই!"
কথাটা বলেই সানভী হনহন করে বেরিয়ে গেলো!
সেইদিন রাতেই নীলা সানভীকে মেসেজ করলো! মেসেজে সে লিখলো, "সেদিন রাগ করে আপনাকে তুই করে বলেছিলাম প্রথমেই সেটার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে চলার মতো মন-মানসিকতা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই! জেসি আমায় থাকতে পরতে দিয়েছে, আপনি দয়া করে পরবর্তীতে এমন কিছু করিয়েন না যাতে সে আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়! ভালো থাকবেন! বাই!"
সানভী তখন বাইকে ছিলো। তাই সে মেসেজটা পড়তে পারেনি! রুমে গিয়ে মেসেজটা দেখতেই ওর খুব খারাপ লাগা কাজ করলো। নিজের বোকামীর জন্য মনে মনে নিজেই নিজেকে গালি দিতে লাগলো!
সে যেই কাজ গুলো আগে ভুল করেও করতো না এখন সেগুলো ইচ্ছা করেই করছে। তার উপরে আবার নীলাকে শুধু শুধু মাঝখান থেকে কষ্ট দেওয়ার প্ল্যান করছে। যেটার কোন মানেই হয়না। সে বুঝতে পারলো সে যা করেছে তার চেয়ে বড় কোন বোকামী আর হয় না!
সে সিয়ামকে ফোন দিয়ে নীলাকে ফলো করতে নিষেধ করলো!
রিশার রুপ-সৌন্দর্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চ বংশ কোনটায় সানভীর মন থেকে নীলার ভালোবাসা সরিয়ে দিতে পারলো না! সে রিশার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো!
সানভী সিয়ামকে নিয়ে জেসিদের বাসার সামনে বাইকে বসে আছে। মেসেজ করে নীলাকে নিচে আসতে বলেছে। কিছুক্ষণ পর নীলা চলে আসলো। নীলাকে আসতে দেখেই সিয়াম বড় করে একটা সালাম দিলো। নীলা ধীর গলায় সালাম নিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো!
সানভী বাইক থেকে নেমে নীলার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বললো-
--"আই এম সরি নীলা! অনেক ভেবে দেখলাম। তোমার সাথে যা করেছি তা অন্যায় করে ফেলেছি! আসলে ছোটবেলা থেকেই বাবা মা সব কিছু প্রয়োজনের আগেই দিয়ে রাখতো। তাই কোন জিনিসটার কতোটা প্রয়োজন সেটার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার হয়নি। তবে এই কয়দিনে এতোটুকু বুঝেছি তোমাকে আমার অনেক প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন বললে ভুল হবে তার চেয়েও বেশি কিছু। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার বউ কারো কাছে আশ্রিতা বা দয়ার পাত্রী হয়ে থাকবে আর আমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবো এ কখনো হতে পারেনা!"
সানভীর কথাগুলো শুনে নীলা বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে সে বাস্তবে আছে নাকি স্বপ্নে! সে ভ্রু জরিয়ে ছোট ছোট চোখ করে সানভীর দিকে তাকিয়ে বললো-
--"আমি এখন কি বলবো বা কি বলা উচিত কিছুই বুঝতে পারছিনা। আপনি এখন চলে যান।"
সানভী নীলার চোখে চোখ রেখে বললো-
--"আমি উত্তর না জেনে যাবোনা...."
সানভীর শেষ কথাটা শোনা মাত্রই নীলা ওর চোখ থেকে নিজের চোখ নামিয়ে নিলো।
কয়েক সেকেন্ড পর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
--"আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। প্লিজ আপনি চলে যান! আমি ফোনে জানিয়ে দিবো!"
কথাটা বলেই নীলা খুব দ্রুত গতিতে বাসায় চলে গেলো! রুমে গিয়েই জেসিকাকে জড়িয়ে ধরলো। জেসিকা উৎসুক দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে বললো-
--"নিশ্চয় সানভী তোকে বলেছে সে তোকে অনেক লাভ করে রাইট?"
--"হুম সেরকমই কিছুটা!"
--"বেস্ট অফ লাক বাবু!"
--"হুম!"
নীলা তো খুশিতে ফেটে পরতে লাগলো। কারন সে খুব সূক্ষ্ম ভাবে সানভীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে! সানভীর মুখের ভাষার সাথে চোখের ভাষার সম্পূর্ণ মিল ছিলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো সানভীর কাছে ফিরে যাবে। কারন অমূল্য জিনিস ফিরে পেলে সেটা হেলাই ফেলে দিতে নেই। নয়তো পরে আফসোস ছাড়া আর কিছু জোটে না! সে সানভীকে পেয়ে আর হারাতে চায়না। তার ছোট্ট চিন্তা ভাবনার রাজ্যে আপাতত এতোটুকুই ঘুরপাক খেতে লাগলো!
নীলা সানভীকে মেসেজ করে পরদিন দেখা করতে চাইলো! সানভী নীলার রেসপন্স পেয়ে এতোটাই খুশি হলো যে সে ওর সব ফ্রেন্ডদেরকে ট্রিট দেলো! নীলার জন্য একটা ডায়মন্ড রিং কিনলো।
বাসায় গিয়ে ওর মাকে পরদিন একটা বিশাল সারপ্রাইজ দিতে চাইলো।
সানভী এতো তাড়াতাড়ি নীলার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতো না। হয়তো আরো কিছুদিন সময় নিতো চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার! কিন্তু তার অঢেল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী অন্যের দয়ার পাত্রী হয়ে আছে এটা সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছেনা।
বিকেলবেলা।
সানভী সেন্ট্রাল পার্কে বসে নীলার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে পাঞ্জাবী পরে এসেছে। নীল রঙের পাঞ্জাবীতে ওর সৌন্দর্য বেড়ে আরো দিগুন হয়ে গেছে। সে নীলাকেও সিয়ামের দ্বারা নীল রঙের কয়েকটা শাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর যেটা পছন্দ হবে সেটা পরে আসবে!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো তবু নীলার আসার সাথে কোন নাম নেই! সে নীলাকে বার বার কল করতে লাগলো কিন্তু নীলার কোন রেসপন্স পেলো না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরও যখন নীলা পার্কে আসলো না, তখন সানভী মিট করার আশা ত্যাগ করে বাসায় রওনা দিলো!
অর্ধেক রাস্তা না যেতেই ওকে জেসিকা ফোন করলো! সানভী সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে জেসিকা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
--"সানভী নীলা কি তোমার সাথে আছে?"
সানভী বাইক থামিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো-
--"না কেনো? নীলা বাসায় নেই?"
--"আসলে ওর ফোন থেকে শুরু করে সকল জিনিস পত্র রুমে আছে, শুধু ওই নেই! তুমি প্লিজ একটু আমাদের বাসায় আসো সামনা সামনি কথা হবে!"
সানভী সিয়াম কে নিয়ে প্রায় বিদ্যুত বেগে জেসিদের বাসায় পৌঁছুলো। সে নীলার রুমে গিয়ে দেখলো তার পাঠানো শাড়ি গুলো বেডের উপরে পরে আছে! বালিশের পাশে ফোনটা উল্টো করে রাখা আছে! আনলায় ওর পড়নের কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখা আছে! রুমে বিশেষ তেমন কিছু অগোছালো চোখে পরলো না! সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবে রাখা আছে! সানভী তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পুরো গোটা রুম পর্যবেক্ষণ করেও কোন ইস্যু খুঁজে পেলো না!
তাই সে উদগ্রীব হয়ে জেসিকাকে বললো-
--"কতক্ষন থেকে সে নেই?"
জেসিকা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো-
--"দুপুরে বাইরে যাওয়ার সময় আমি ওকে দেখে গিয়েছিলাম! তখন সে চুল বাঁধছিলো! সন্ধ্যার একটু আগে এসে দেখি সে নেই।"
--"দরজা কি লক করা ছিলো?"
--"হ্যাঁ, দরজা বাহির থেকে লক করা ছিলো! আমি ওকে পুরো বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। ওর পরিচিত যে দুই একজনকে আমি জানি তাদের কাছেও নক করেছি। কিন্তু কেউ ওর বিষয়ে কিছু বলতে পারছেনা! শেষে বাধ্য হয়ে তোমার কাছে নক করলাম।"
সানভী নীলার ফোন হাতে নিয়ে দেখলো কল লিস্টে শুধু ওর আর জেসির নাম্বার আছে!
সানভীর চোখে মুখে স্পষ্ট ভাবে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। সে সিয়ামকে নিয়ে নীলার পরিচিত প্রত্যেকটা জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো! কিন্তু কোথাও নীলার হদিস খুঁজে পেলো না। শেষে বাধ্য হয়ে থানায় ডায়েরী করে বাসায় রওনা দিলো!
রাত প্রায় দশটার দিকে সানভী বাসায় চলে আসলো! সাহানা বেগম তখন কিচেনে রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই সানভীর আগমন তার দৃষ্টিপাত হলোনা।
সানভী রুমে গিয়েই দরজা লক করে দিলো! সোফার উপর বসে বাম হাত দিয়ে কিছুক্ষণ শক্ত করে কপাল চেপে ধরে রাখলো। আবেগের অতিমাত্রায় চলে গেলে মানুষের যেমন স্বাভাবিক সেন্স হারিয়ে যায় সানভীর সাথেও ঠিক তেমনি হলো। অনেক চেষ্টা করেও সে কান্না থামাতে পারলো না। নীলার কথা মনে হতেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সানভীর কান্নার শব্দ শুনে সাহানা বেগম দৌড়ে ওর রুমে চলে আসলো। ভেতর থেকে দরজা লক করা থাকায় সানভীর নাম ধরে ডাকতে লাগলো! কিন্তু সানভীর সেদিকে কর্ণপাত নেই। সে ছোট বাচ্চাদের মত করে একটানা কাঁদতে লাগলো!
কিছুক্ষণ পর সানভীর বাবা এসে দরজা নক করার পর সে খুলে দিলো। চোখ দুটো তার রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে। সে দরজা খুলেই ওর মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সানভীর বাবা অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো-
--"কি হয়েছে তোমার? আমায় বলো!"
সাহানা বেগম ও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুক্ষণ পর সানভী কান্না থামিয়ে বললো-
--"নীলাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!"
সাহানা বেগম খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন-
--"তাতে আমাদের কি! মাথার উপর থেকে বোঝা টা নেমে গেছে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর!"
সানভী অভিমান করে বললো-
--"তুমি কাকে বাইরের মানুষ বলছো মা? নীলাকে? সে কিভাবে বাইরের মানুষ হয়?"
--"অতো কিছু আমি জানিনা! তুই যদি ফের ঐ হতচ্ছাড়ি টার কথা তুলিস তাহলে কিন্তু আমি আর এই বাসায় থাকবোনা! আর হ্যাঁ, তুই ভুলে যাসনা যে তোর কথা মতোই কিন্তু সব কিছু হয়েছিলো!"
কথাগুলো বলেই সাহানা বেগম হনহন করে তার রুমে চলে গেলো! সানভী ওর বাবার দুই হাত ধরে বললো-
--"আমি জানি বাবা, যা কিছু হয়েছে সব আমার কথাতেই হয়েছে! কিন্তু তাই বলে তোমরা এখন আমার ভুল টাকেই সঠিক বলে ধরে নেবে? আমাকে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে দেবে না?"
সানভীর বাবা খুব ভেবে চিন্তে কথা বলতে লাগলেন-
--"তুমি তো জানো, তোমার বিয়ের ব্যাপার টা তোমার মা নিজে দায়িত্ব করে নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলো! কিন্তু তোমার কিছু বোঝার ভুলে সে তার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে এখন ভীষণ রেগে আছে! তাই আপাতত নীলার বিষয় টা এখন না উঠানোই ভালো হবে!"
কথাগুলো বলেই সানভীর বাবাও ওনার রুমে চলে গেলেন! সানভী সেদিন রাতের খাবার না খেয়েই সারা রাত কেটে দিলো!
বিগত কয়েকদিন থেকে সানভীর ঘুম, নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেছে। সে খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে রাত এগারো বারোটা পর্যন্ত তার চেনা জানা প্রত্যেকটা জায়গায় নীলাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে! বাসার কারো সাথে ঠিক ঠাক মতো কথা বলেনা! রিশা যদি একটু আধটু কথা বলার সুযোগ খোঁজে তাহলে সানভীর চোখ মুখের চাহনি দেখেই সে ভয়ে কথা বলার সাধ হারিয়ে ফেলে!
সানভীর মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। নরমাল কথাতেও সে রেগে যায়!
সাহানা বেগম সানভীকে প্রায় ব্লাকমেইল করার মতো করে রিশাকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছেন! তিনি সানভীকে বলেছেন যদি সে বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে উনি সুইসাইড করবেন!
আজ সানভীর বিয়ে! এই কয়দিনে তার নীলার উপরে যথেষ্ট রাগ আর অভিমান জমা হয়ে গেছে। সে বিয়েতে সম্মতি জানানোর পূর্ব মহুর্তে শুধু একটা কথায় ভেবেছে, যদি নীলা ওকে সত্যি ভালোবাসতো তাহলে কখনোই ওকে ফেলে এভাবে হারিয়ে যেতোনা!
সানভী সারাদিন ঘুমিয়ে ঠিক সন্ধ্যার দিকে উঠে পরলো। গোসল সেরে বরের বেশে ঝিম মেরে বসে রইলো। প্রথমবারের মতোই এবারো তার মনে কোন আনন্দের রেশ নেই!
বাসায় রিশার ফ্যামিলির কিছু লোকজন, সিয়াম, জেসিকার ফ্যামিলির কিছু লোকজন আর সানভীর ফ্যামিলির সদস্যরা ছাড়া বাহিরের কোন লোকজন নেই!
সানভীর বাসাতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। জাস্ট পাত্র-পাত্রীকে শুধু আলাদা রুমে রেখে কবুল নেওয়া হয়েছে। সানভী অবশ্য একবারো জানতে চায়নি কেনো রিশার বাসাতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হলো না। সেদিকে তার কোন আগ্রহ নেই!
তার মাথায় এখন শুধু একটা চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কখন রাত পেরিয়ে ভোর হবে আর কখন সে দেশের বাইরে পাড়ি জমাবে!
প্রায় মাঝরাতের দিকে সানভী বাসর ঘরে প্রবেশ কলো। যদি ওর রুমে বাসর সাজানো না হতো তাহলে সে বাসর ঘরে ভুল করেও প্রবেশ করতো না। এসেই সে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করলো। কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে কাগজ পত্র সব। বেডের দিকে সে ভুল করেও তাকালো না।
সবাই জেগে ওঠার আগেই সে খুব ভোরে বাসা থেকে বের হবে। তাই সব কিছু প্যাকেট করে নিয়ে সে গেস্ট রুমে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে গেলো। কিন্তু দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো বাহির থেকে দরজা লক করা।
রাগে সে চিৎকার চেঁচামেচি করতে চাইলো! কিন্তু ভদ্রতা বজায় রাখতে গিয়ে সেগুলো কিছুই করতে পারলো না!
এতোক্ষণ পর সে বেডের দিকে তাকালো। আর তাকাতেই সে কিছুটা চমকে গেলো। নীলা যেমন বাসর রাতে বড় একটা ঘোমটা টেনে বসেছিলো রিশাও তেমনি একটা বড় ঘোমটা টেনে বসে আছে। তার চেয়েও বেশি অবাক করার বিষয় হলো সেদিন নীলার পড়নে যে শাড়ি ছিলো আজ রিশার পড়নেও সেই একই শাড়ি!
তবু সানভীর সেদিকে কোন ইন্টারেস্ট নেই। সে চুপচাপ সোফায় গিয়ে শুয়ে পরলো! একটু পর ওর মা আর রিশার মা একটা গ্লাসে করে সরবত নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। সানভী শোয়া থেকে উঠে বসলো! রিশার মা সানভীর হাতে সরবতের গ্লাস টা দিয়ে বললো-
--"নাও বাবা, এটা আগে তুমি খাও তারপর ওকে খাওয়াও!"
সানভী মুখটা কাঁচুমাচু করে ঢোক গিলতে গিলতে গ্লাস টা হাতে নিলো। এক চুমুক খেয়েই সে রিশার কাছে গেলো! রিশার ঘোমটা টা তুলতেই সে যেনো আকাশ থেকে পরলো। সাথে গ্লাস টাও হাত থেকে পরে গেলো!
এ যে নীলা! সানভী ফ্যালফ্যাল করে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর এক এক করে সবাই রুমে আসলো! রিশা, জেসি, সিয়াম! মুলত এই তিনজনেরই প্ল্যান টা ছিলো!
কিছুক্ষণ পরেই সানভীর ঘোর কেটে গেলো! সে রিশাকে একটা বড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে দিলো। সবাই কিছুক্ষণ সানভীকে জ্বালিয়ে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো! সানভী দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো!
নীলা সানভীকে দেখে ভয়ে মুখ আমতা আমতা করে বললো-
--"আআমি কিন্তু কিছু করিনি!"
সানভী একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বললো-
--"নো প্রবলেম! আমিও জানি কিভাবে সবকিছু সুদে আসলে বুঝে নিতে হয়!"
কথাটা বলেই সে রুমের লাইট অফ করে দিলো!
নীলা ঢোক গিলতে গিলতে বললো-
--"ঐ রুমের লাইট অফ করলে ক্যান?"
সানভী শয়তানি হাসি দিয়ে বললো-
--"সরি মাই ডার্লিং! রুমের লাইটে আমারও কোন আপত্তি নেই!"
সানভীর কথা শুনে নীলা তো পুরাই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো!
।।সমাপ্ত।।
No comments