আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়েযার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনিজন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছঁকে বন্দীযার লগ্ন রাশি রাহু কেতুরদিশা খোঁজা হয়েছে না, তার নিজের জন্য নয়তার পিতার জন্য আর ভাই এর জন্যতার স্বামীর জন্য তার পুত্রের জন্যকিন্তু যার গর্ভ থেকে আমার জন্মসেই মায়ের কথা বলেনি কেউ।আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়েটিযে জন্ম থেকেই বিবাহেরজন্য বলি প্রদত্তযার বাইরের চেহারাচোখ – নাক-মুখ- ত্বক- চুল – রঙনিয়েই দর কষাকষিকাল না ফর্সাখাঁদা না টিকালোলম্বা না বেঁটেখুতখুতে না টানা টানাযার মাথার বাইরেটা নিয়েই সকলের ভাবনামাথার ভিতরটা নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেইআমিই সেই মেয়েটি যে ছোটবেলা থেকে শুনেছেজোরে জোরে কথা বলতে নেইছুটতে নেই -চেঁচাতে নেই- হাসতে নেইএমন কি কাঁদলেও তা লুকিয়ে লুকিয়েআমিই সেই মেয়েটি যাকে বলতে নেই –খিদে পেয়েছে – ঘুম পেয়েছে – ইচ্ছে করছেনা-ক্লান্ত লাগছে -আর পারছিনা — আর পারছিনা।আমিই সেই মেয়েটি খেলার জন্য যারহাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুতুলপুতুলের আদল পাবার জন্যপুতুলের সংসার বানাবার জন্য।আমিই সেই মেয়েটি যে গত কোনশতাব্দী তে পাঁচ বছর বয়সে মালা দিয়েছে –গঙ্গা যাত্রীর গলায়কুলীন ব্রাম্মন এর তিনশো পঁয়ষট্টি তম স্ত্রীরঅন্যতমা হয়ে স্বামীর গরবে হয়েছি গরবিনীএকাদশীর দিন অবুজ দশমীর বালিকার তৃষ্ণায় –আটক ঘরের মাটি লেহন করতে করতে প্রান ত্যাগ করেছিসন্তানের পর সন্তান জন্ম দিতে দিতে যন্ত্রণায়মুখ থুবড়ে পরেছি সূতিকাগারেজ্বলে পুড়ে মরেছি সতীদাহে।আমি বুঝতে পারিনি যে চাকরীর জায়গায়নিজের কাজের কুশলতা দেখাতে নেইআমি বুঝতে পারিনি যে আমার প্রেমিককেতার প্রেম পত্রের বানান ভুল গুল ধরিয়ে দেওটাইআমার ভুল হয়ে ছিলআমি বুঝতে পারিনি আমি যদি কবি হতে চাইআমার বন্ধুরা বলবে ''ওটা কবিতা হয়নি পদ্য হয়েছে''আমি বুঝতে পারিনি যে বিংশ শতাব্দীর শেষ সীমানায় এসে দাড়িয়েওএইপুরুষ শাসিত সমাজ বুদ্ধিমতিদের জন্য অপ্রস্তুতআমি সেই মেয়েটি যে দেখেছে একটি নারীকেমন করে নিছক মেয়েছেলে বনে যায়চরিত্রের উলটো দিকে হেঁটে যায় সফল স্বামীদের গিন্নীরাশিক্ষার চেয়ে উজ্জলতা পায় বেনারসি সাড়ীর ফুলকিবুদ্ধির চেয়ে দিপ্তিমান হয়ে ওঠে অন্ধকারে হীরা পান্নাআমি সেই মেয়েটি জানেন আমি সেই মেয়েটিযে জীবনের কয়েকটি বছর ভুলের পরে ভুলপুনরুপি ভুল করে চলেছিঅন্ধকারের দিনে ফিরতে পারিনা বলেই কিআমি অপমানের জলন্ত কয়লার উপর দিকে হেঁটে যেতে চাইযেতে চাই দুঃখের দিকেআমি প্রনাম জানাই সেই প্রথম আগুনকেযার নাম বর্ণপরিচয়সেই অগ্নি সুদ্ধ পরম্পরাকে সেইসব পুরুষ রমণীকেযারা উনবিংশ শতাব্দীর অন্ধকারের হাতলে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েএক জন্মে আমাকে জন্ম জন্মান্তরের দরজা খুলে দিয়েছে।আমি আজ প্রেমের জন্য ফেলে যাচ্ছি আরাম-শোকার্জিত শাকান্নের জন্য ফেলে যাচ্ছি ক্রীতদাসের চর্ব্যচোষ্যজেগে থাকার জন্য ফেলে যাচ্ছি ভাত ঘুম,যন্ত্রণার জন্য ফেলে যাচ্ছি সুখ –জ্ঞানের জন্য ফেলে যাচ্ছি অন্ধতাআনন্দের জন্য ফেলে যাচ্ছি সাফল্যঅমৃতের জন্য ঐশ্বর্য।আমার হাতে জ্বলছে দিশারীদের শিক্ষার মহান আগুনআমিই সেই মেয়েটি———আপনারা নিজের দর্পণে দেখে আমাকে চিনুনআমাকে চিনুন – আমাকে চিনুন।।
- কবিতা সিংহ
No comments